Thursday, June 27, 2024

অখন্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রস্তাব ব্যর্থ হয় কেন? আলোচনা কর।

ভূমিকা : ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মি. জিন্নাহ এর সাথে আলোচনায় বসেন।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুসহ অন্যান্য বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা কিরণ শংকর রায় প্রমুখ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে। এ প্রচেষ্টা সফল হলে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি অবিভক্ত বাংলা তৃতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো। কিন্তু বাঙালিদের ভুল বোঝাবুঝি এবং মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কায়েমি স্বার্থরক্ষায় অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ : ১৯৪৭ সালে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের এঁচেষ্টা যে সকল কারণে ব্যর্থ হয় তা বর্ণনা করা হলো :

১. হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ : ভারত বিভক্তির পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ এক দশক (১৯৩৭ – ১৯৪৭) সময়কালে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় সরকার পরিচালনায় কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখার সুযোগ পায়নি। এ সময় মুসলমানরা রাষ্ট্র পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকায় ছিল। এজন্য হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক হতাশা ও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেয়। এ অবস্থার জন্য সর্বভারত ভিত্তিক হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক মেরুকরণ বহুলাংশে দায়ী ছিল এবং এ থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলা বিভক্তির মানসিকতা সৃষ্টি হয়। অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

২. কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের অনীহা : কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন করেনি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যে সকল নেতৃবৃন্দ অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল তারা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের হাইকমাণ্ডের বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত বাংলা বিভক্তির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।

৩. বাংলার জনসংখ্যা বণ্টন সমস্যা : বাংলার পশ্চিম অংশে হিন্দু এবং পূর্ব অংশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। জনসংখ্যার এরূপ বণ্টন সাম্প্রদায়িকতার বা ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশগুলোকে বিভক্তি করা সহজতর করে তোলে।

৪. সর্বভারতীয় ভিত্তিক হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ : বাংলা বিভক্তির জন্য সর্বভারতীয় ভিত্তিক হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক মেরুকরণ বহুলাংশে দায়ী ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ফলে অবিভক্ত বাংলা গঠন প্রস্তাব বানচাল হয়ে যায়।

৫. সময়ের সীমাবদ্ধতা : যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ক্ষেত্রে সময়ের সীমাবদ্ধতা একটি অন্যতম বাধা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত) ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারত পরিত্যাগের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়। কিন্তু কার্যত তারা এর পূর্বেই আগস্ট ১৯৪৭ ভারত ত্যাগ করে। সময়ের সীমাবদ্ধতার ফলে পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়।

৬. ১৯৪৬ সালের কোলকাতা দাঙ্গা : ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’ সংঘটিত ভয়াবহ কোলকাতা দাঙ্গার পর থেকে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বাংলা বিভক্তির পক্ষে প্রচারণা চালাতে স্বার্থান্বেষী হিন্দু মালিকানাধীন পত্রিকাগুলোর জন্য অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ভয়াবহ সন্দেহের সৃষ্টি হয় ।

৭. ব্রিটিশ সরকারের আন্তরিকতার অভাব : ব্রিটিশ সরকারের আন্তরিকতার অভাবে বাংলা বিভক্ত হয়। মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেন। তেমনি বাংলা বিভাগের সিদ্ধান্তের পর গঠিত সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান র‍্যাড ক্লিফ কংগ্রেসের পক্ষ অবলম্বন করেন। ফলে স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।

উপসংহার : পরিবেশে বলা যায় যে, ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে ভারত বিভক্ত হয় এবং পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে অবিভক্ত বাংলা গঠনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে সোহরাওয়ার্দী ও বসু। কিন্তু মুসলিম লীগ কংগ্রেস ও অন্যান্য কারণে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন গৃহীত হয়। যদিও আইনটি ছিল উত্তম তথাপি আইনের বেশকিছু ত্রুটি বিদ্যমান থাকায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী তিক্ততা সৃষ্টি করে।

No comments:

Post a Comment