Saturday, June 22, 2024

স্বাধীনতার কী? স্বাধীনতার বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা

ভূমিকাঃ সাধারণ ভাষায় ‘স্বাধীনতা” বলতে মানুষের ইচ্ছামত কোনো কিছু করা বা না করার অধিকারকে বোঝায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে অধীনতামুক্ত অবস্থাই স্বাধীনতা। কিন্তু কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা অরাজকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর। পৌরনীতিতে স্বাধীনতাকে এ অর্থে ব্যবহার করা হয় না। কেননা স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য এতে ব্যাহত হয়। অবাধ স্বাধীনতার অস্তিত্ব কোনো সমাজেই থাকতে পারে না। সমাজে প্রতিটি মানুষ যদি অনিয়ন্ত্রিত ও সীমাহীন স্বাধীনতা উপভোগ করতে চায় তাহলে একের ইচ্ছা র প্রয়োজনের সাথে অন্যের সংঘাত দেখা দেবে। সমাজে সকলের নিরাপত্তা ও সম্মান ব্যাহত হবে। তাই সমাজের সকল সদস্যের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও নিশ্চিত নিরাপত্তা বিধানের জন্য ব্যক্তিদা আচার-আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা আবশ্যক। শেলী (Shelly) বলেছেন যে, 'অতি শাসনের বিপরীত ব্যবস্থাই হলো স্বাধীনতা।' (Liberty is the opposite of over government.)

স্বাধীনতার সংজ্ঞা (Definition of Liberty):
‘স্বাধীনতা' শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Liberty'। ‘Liberty' শব্দটি ল্যাটিন ‘Liber’ থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘free' বা স্বাধীন। সুতরাং শাব্দিক অর্থে মানুষের ইচ্ছানুযায়ী কিছু করা বা বলার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলা হয়। সাধারণ ভাষায় ‘স্বাধীনতা” বলতে মানুষের ইচ্ছামত কোনো কিছু করা বা না করার অধিকারকে বোঝায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে অধীনতামুক্ত অবস্থাই স্বাধীনতা। কিন্তু কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা অরাজকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর।

পৌরনীতিতে স্বাধীনতাকে এ অর্থে ব্যবহার করা হয় না। কেননা স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য এতে ব্যাহত হয়। অবাধ স্বাধীনতার অস্তিত্ব কোনো সমাজেই থাকতে পারে না। সমাজে প্রতিটি মানুষ যদি অনিয়ন্ত্রিত ও সীমাহীন স্বাধীনতা উপভোগ করতে চায় তাহলে একের ইচ্ছা র প্রয়োজনের সাথে অন্যের সংঘাত দেখা দেবে। সমাজে সকলের নিরাপত্তা ও সম্মান ব্যাহত হবে। তাই সমাজের সকল সদস্যের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও নিশ্চিত নিরাপত্তা বিধানের জন্য ব্যক্তিদা আচার-আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা আবশ্যক।

লেখক ও চিন্তাবিদগণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) তার 'Essay on Liberty' গ্রন্থে বলেছেন, "মানুষের মৌলিক শক্তির বলিষ্ঠ, অব্যাহত ও বিভিন্নমুখী প্রকাশই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অর্থ মানুষ কর্তৃক নিজস্ব উপায়ে কল্যাণ অনুদাবন করা।" তিনি আরো বলেন, "নিজের ওপর, নিজের দেহ ও মনের ওপর ব্যক্তিই সার্বভৌম।"

হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer) বলেন, "স্বাধীনতা বলতে খুশিমত কাজ করাকে বোঝায়, যদি উক্ত কাজ দ্বারা হার্বাট স্পেনসার (Herbert Spencer) অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা উপভোগে বাধার সৃষ্টি না হয়।" (livery man is free to do whatever he wills, provided he infringes not the equal freedom of any other man.)

টি. এইচ. গ্রিন (T. H. Green) বলেন, “যা উপভোগ করার এবং সম্পন্ন করার যোগ্য তা উপভোগ ও সম্পাদন করার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলে।" (Freedom consists in a positive power or capacity of doing or enjoying something worth, doing or worth. Enjoying)

অধ্যাপক হ্যারল্ড জে. লাস্কি (Prof. H. J. Laski)-এর মতে, নেতিবাচক অর্থে "স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সে সকল সামাজিক অবস্থার ওপর থেকে বাধা-নিষেধের অপসারণ, যা আধুনিক সভ্যজগতে মানুষের সুখী জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যক।" (By liberty I mean the absence of restraints upon the existence of those social conditions which-in modern civilization are the necessary guarantees of individual happiness.)

হ্যারল্ড জে. লাঙ্কি-এর মতে, ইতিবাচক অর্থে, “স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সেই পরিবেশের সাগ্রহ সংরক্ষণ যেখানে মানুষ তার সত্তাকে পূর্ণ উপলব্ধি করার সুযোগ লাভ করতে পারে।" (By liberty I mean the eager maintenance of that atmosphere in which men have opportunity to be their best selves.)

স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ (Forms of Liberty): স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ

১. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা পৌর স্বাধীনতা (Individual or Civil Liberty): যে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটাতে পারে, তাকে ব্যক্তিগত বা পৌর স্বাধীনতা বলে। এ স্বাধীনতা ব্যক্তিগত সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যক্তির বাহ্যিক কিছু আচরণের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণবিহীনতা। যেমন-ইচ্ছামত রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডে চলাফেরার অধিকার, নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার, সম্পত্তি ভোগের অধিকার প্রভৃতি।

২. প্রাকৃতিক স্বাধীনতা (Natural Liberty): রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ 'প্রকৃতির রাজ্যে' যে স্বাধীনতা উপভোগ করতো, তাকে স্বাভাবিক স্বাধীনতা বলা হয়। সামাজিক চুক্তিবাদী দার্শনিক হস, লক, রুশো এরূপ স্বাধীনতার বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। রুশোর বক্তব্যে এ স্বাধীনতা সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে। যেমন-“মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলাবদ্ধ।” (Man is born free, but everywhere he is in chain.) নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকগণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের মাধ্যমে এরূপ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।

৩. আইনগত স্বাধীনতা (Legal liberty):
রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে আইনগত স্বাধীনতা বলা হয়। স্বাধীনতা নির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত।

৪. সামাজিক স্বাধীনতা (Social Liberty):
সমাজে সভ্য-সুন্দর জীবনযাপন করতে গেলে যে অনুকূল পরিবেশ ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রয়োজন তাকে সামাজিক স্বাধীনতা বলে। যেমন- চলাফেরার স্বাধীনতা, জীবনযাত্রার স্বাধীনতা ইত্যাদি। মানুষের অধিকার বোধের ধারণা থেকে সামাজিক স্বাধীনতার জন্ম।

৫. রাজনৈতিক স্বাধীনতা (Political Liberty): হ্যারল্ড জে, লাস্কির মতে, “রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ভূমিকা পালনের ক্ষমতাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলে।” (Political liberty means the power to be able in the affairs of state.) রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার বোঝায়। ভোটদানের অধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার, নিরপেক্ষভাবে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার ইত্যাদি হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা।

৬. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা (Economic Liberty): অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী জীবিকা নির্বাহের 'স্বাচ্ছন্দ্য ব্যবস্থা এবং দৈনন্দিন অভাব, অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি। লাস্কির মতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হচ্ছে, “প্রতিনিয়ত বেকারত্বের আশঙ্কা ও আগামীকালের অভাব থেকে মুক্ত এবং দৈনিক জীবিকার্জনের সুযোগ প্রদান।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতে, “অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ অভাব থেকে মুক্তি।” অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মে নিযুক্ত হবার অধিকার, বেকার ও বৃদ্ধ বয়সে ভাতা পাবার অধিকার, রুগ্ন-অক্ষম অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিপালন, উপযুক্ত মজুরি লাভ ইত্যাদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।

৭. জাতীয় স্বাধীনতা (National liberty):
বৈদেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করে যখন একটি জাতি পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জন করে তখন তাকে 'জাতীয় স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব' বলে। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ একটি জনসমষ্টি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন ও রাষ্ট্র গড়ে তুলে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে। জাতীয় স্বাধীনতা ব্যতীত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। জাতীয় স্বাধীনতা সব ধরনের স্বাধীনতার মূলভিত্তি।

পরিশেষঃ
অতএব, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী অনুকূল সামাজিক ব্যবস্থা বা পরিবেশই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অর্থ যা কিছু করার ক্ষমতা নয়। 

No comments:

Post a Comment