Friday, June 28, 2024

বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর অধিকার

 

বাংলাদেশের সমস্ত কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সরব অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবক্ষেত্রে নারীর পদচারণা যেমন বেড়েছে, তেমনি সমাজে নারীকে শক্তিশালী করতে তৈরি করা হয়েছে আইনি সুরক্ষা বলয়, যার ওপর দাঁড়িয়ে এখন নারী সংকটে সংগ্রাম করতে শিখেছে ও শিখছে।

জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় নারীপুরুষ নির্বিশেষে সমান মানবিক মর্যাদা, আইনের আশ্রয়লাভ, কর্ম বেছে নেয়া ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিবাহ, দাম্পত্য জীবন এবং বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ দুজনের সমান অধিকার এবং সাধারণ স্বাস্থ্য কল্যাণের পাশাপাশি মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপর জোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের এসব অঙ্গীকারের প্রতিফলন রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো আমাদের সংবিধানেও নারীর অধিকার নিয়ে স্পষ্ট বলা আছে। সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে অত্যন্ত সুনিপুণ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে নারীর অধিকারগুলো। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীই তার সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। তারা জানে না, একজন মানুষ কিংবা রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে কী তার অধিকার। ফলে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হতে পারে না।

বাংলাদেশে নারীদের সাংবিধানিক অধিকার: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের আলোকে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমঅধিকার নিশ্চিত করার কথা বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নারীপুরুষ ধমর্বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার নিশ্চিতসহ সমঅধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল সুযোগ সুবিধা, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করাই সংবিধানের মূল মন্ত্র।

বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে নারীদের নিম্নবর্ণিত অধিকারের কথা নিশ্চিত করা হয়েছে:

অনুচ্ছেদ ০৮। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি

জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা

এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।

অনুচ্ছেদ ১০। সমাজতন্ত্র ও শোষণ মুক্তি

মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।

অনুচ্ছেদ ১১। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার

প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে [এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।]

অনুচ্ছেদ ১৯। সুযোগের সমতা

() সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।

() জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।

অনুচ্ছেদ ২৭। আইনের দৃষ্টিতে সমতা সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

অনুচ্ছেদ ২৮। ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য

() কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।

() রাষ্ট্র ও গণ জীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।

() কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।

() নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অনগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধানপ্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।

অনুচ্ছেদ ৩৮। সংগঠনের স্বাধীনতা জনশৃংখলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে

তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যক্তির উত্তমরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি:

() উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;

() উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;

() উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা

() উহার গঠন ও উদ্দেশ্যে এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।]

অনুচ্ছেদ ৬৫ । সংসদ প্রতিষ্ঠা

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫ () এ জাতীয় সংসদের পঞ্চাশটি আসন কেবল মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে যারা জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে একক হস্তান্তর যোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।

নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ কুসংস্কার অনেক পুরনো। পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে উগ্র সামপ্রদায়িক রাজনীতি। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই নারীদের অগ্রসর হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পুরুষের লড়াই সমাজে ও রাষ্ট্রে মানুষ হিসেবে। কিন্তু নারীর লড়াই মানুষ হিসেবে তো আছেই সে সাথে নারীর হিসেবেও তাকে আলাদা লড়াইয়ে সামিল হতে হয়।

নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখার পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন বদল না হবে, নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার মানসিকতা যতদিন গড়ে না উঠবে ততদিন নারীকে অসম্মান এবং বৈষম্যের শিকার হতে হবে বলেই মনে করা হয়। তবে নারীর লড়াইয়ে একটা বড় হাতিয়ার তার সাংবিধানিক অধিকার। অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে বন্ধুর পথ চলা সহজ হবে। 

 

 বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর অধিকার -- রিমঝিম আহমেদ

No comments:

Post a Comment