বঙ্গভঙ্গ
বঙ্গভঙ্গ
বঙ্গভঙ্গ
পূর্বে 'বাংলা প্রেসিডেন্সী' নামে যে বৃহৎ আয়তনবিশিষ্ট বঙ্গ প্রদেশ ছিল
তার পূর্বাঞ্চলের ৩টি বিভাগ_ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম ছিল পশ্চিমাঞ্চলের
পশ্চাদভূমি। পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ বহুদিন ধরে এর বিভক্তি
কামনা করে আসছিল। লর্ড কার্জনের নিকট নবাব স্যার সলিমুলস্নাহ ভারতের মুসলিম
নেতাদের নিয়ে এর বিভক্তি দাবি করেন। তদানীনত্মন রাজনৈতিক প্রেৰাপটে সুচতুর
ইংরেজ সরকার এ দাবি বাসত্মবায়নে মনোযোগ দেয়। ইংরেজ সরকার কয়েকটি কারণের
ওপর ভিত্তি করে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রামের সাথে
আসামকে যুক্ত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে ঢাকাকে
এর রাজধানী ঘোষণা করে। এটাই বঙ্গভঙ্গ।
বঙ্গভঙ্গের কারণ
বিরাট এলাকা ও বিপুল জনসংখ্যা অধু্যষিত বাংলাকে দুটি প্রদেশে সংগঠিত করার পেছনে নিচের কারণগুলো বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য :
১। প্রশাসনিক কারণঃ
প্রশাসনিক সুবিধা ও দৰতা বৃদ্ধি করা বঙ্গভঙ্গের মূল ও প্রাথমিক কারণ।
ব্রি্িটশ সরকারের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে দুটি
আলাদা প্রদেশ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা,
ছোট নাগপুর ও আসাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি। একজন গবর্নরের
পৰে এত বড় প্রদেশ শাসন করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার ছিল। তাই লর্ড কার্জন ১৯০৫
সালে উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে যুক্ত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম'
নামে এক নতুন প্রদেশ গঠন করেন। নতুন প্রদেশের রাজধানী হলো ঢাকা। নতুন
প্রদেশের প্রথম ছোট লাট হলেন র্যামফিল্ড ফুলার। অপরপৰে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও
উড়িষ্যা নিয়ে 'পশ্চিম বঙ্গ' প্রদেশ গঠিত হয়।
২। রাজনৈতিক কারণঃ
পাশ্চাত্যে শিৰার প্রসারের ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় এবং
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এসব আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা।
ঢাকাকে রাজধানী করে সরকার আন্দোলনকে সত্মিমিত করতে সচেষ্ট হয়। এছাড়া
ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের পেছনে নিম্নোক্ত তিনটি উদ্দেশ্য নিহিত ছিল_
ক) জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করাঃ
১৮৮৫ সালে 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস' নামক একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়।
কংগ্রেসের নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে বিশেষ করে 'বাংলা প্রেসিডেন্সিতে'
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরম্ন হয়। এ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা শহর।
সুচতুর ইংরেজ সরকার এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নস্যাৎ এবং আন্দোলনকারীদের
মেরম্নদ- ভেঙ্গে দেয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গ করতে উদ্যোগী হয়। ব্রিটিশ সরকার 'ভাগ
কর ও শাসন কর' নীতি অবলম্বন করে।
খ) মুসলমানদের দাবিঃ
স্যার সলিমুলস্নাহ বঙ্গভঙ্গের পৰে আন্দোলন শুরম্ন করেন। তিনি জনগণকে
বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা
নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের সুযোগ পাবে। হিন্দু সম্প্রদায় প্রভাবিত কলকাতার উপর
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ৰেত্রে নিভর্রশীলতা হ্রাস পাবে। মুসলমান জনগণ চাকরি ও
ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি লাভ করতে পারবে।
গ) আধা-সামনত্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠাঃ
পূর্ব বাংলায় আধা-সামনত্মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা প্রয়াসী
একটি এলিট শ্রেণী গড়ে ওঠে; তারা বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন জানায়।
৩। অর্থনৈতিক কারণঃ
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পূর্বে শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্যি, অফিস-আদালত,
কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রায় সব কিছুই কলকাতার
কেন্দ্রিভূত ছিল। ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা সর্বৰেত্রেই পিছিয়ে পড়েছিল।
অধিকাংশ মুসলমান জনগণ তখন ভাবতে শুরম্ন করে যে, বঙ্গভঙ্গ হলে তারা
অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনের সুযোগ পাবে। এ জন্য পূর্ববঙ্গের মুসলমান জনগণ
বঙ্গভঙ্গের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।
৪। সামাজিক কারণঃ
ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান সম্প্রদায় নির্মমভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের প্রতি উদারনীতি এবং মুসলমানদের প্রতি বৈরী নীতি
অনুসরণ করতে থাকে। মুসলমানরা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন একটি দরিদ্র,
রিক্ত ও নিঃস্ব সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। সুতরাং লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গবঙ্গের
চিনত্মা-ভাবনা শুরম্ন হলে পূর্ববাংলার মুসলমান সম্প্রদায় স্বভাবতই এর
প্রতি সমর্থন জানায়। বঙ্গবঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ তাদের
হারানো প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
৫। ধর্মীয় কারণঃ
অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশে মুসলমানগণ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পশ্চিম অংশে
হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে এ দৃষ্টিকোণ থেকেও দুই সম্প্রদায়ের জন্য
দুটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সাময়িক হলেও বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় বেশী লাভবান হয়েছিল।
১) মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়াঃ
বঙ্গভঙ্গের ফলে নতুন প্রদেশ তথা পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয় ঢাকা।
রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে
মুসলমানগণ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভে সৰম হয়। অফিস-আদালত, শিৰাপ্রতিষ্ঠানসহ
বড় বড় সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠায় ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বঙ্গভঙ্গকে
মুসলমানগণ তাদের হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাবার আনন্দে মেতে ওঠে। নবাব
স্যার সলিমুলস্নাহ পরিকল্পনাটি কার্যকর করার দিন ঢাকার এক জনসভায় বলেন,
"বঙ্গভঙ্গ আমাদেরকে নিষ্ক্রিয়তার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে। এটা আমাদের
উদ্দীপ্ত করেছে কর্ম সাধনায় এবং সংগ্রামে।" অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব
বাংলার গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়।
২) হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াঃ
বঙ্গভঙ্গের বিরম্নদ্ধে হিন্দুদের অবস্থান ছিল খুবই কঠিন। বাংলার উচ্চ ও
মধ্যবিত্ত হিন্দুরাই এর বিরম্নদ্ধে প্রচ- ঝড় তুলেছিল। তারা প্রচার করেন যে,
বঙ্গভঙ্গ 'বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের সমতুল্য।' জাতীয়তাবাদী চিনত্মা-চেতনায়
বিকশিত হিন্দু জনসমাজ মনে করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে
যুক্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছে।
হিন্দু লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাগণ বঙ্গভঙ্গকে বাঙালি
জাতির বিকাশমান ধারাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেন। ব্রিটিশ
সরকারের এই বিভেদ ও শাসন নীতির বিরম্নদ্ধে তারা প্রচ- গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।
ফলে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের জন্য স্বদেশী আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৩) ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশঃ
হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন মোকাবেলা করার জন্য মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও
নেতৃবৃন্দ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
এভাবে হিন্দু -মুসলিম সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এবং তা উত্তরোত্তর
বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মভিত্তিক
জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়।
৪) সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানঃ ১৯০৫
সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে বাংলা, পাঞ্জাব ও
মহারাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। সমগ্র ভারতে
উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিনত্মা-চেতনা বিসত্মৃত হয়।
৫) ব্রিটিশদের 'ভাগ কর ও শাসন কর' নীতির বিজয়ঃ
বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক প্রভাবে ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত 'ভাগ কর ও শাসন কর'
নীতি জয়যুক্ত হয়। ফলে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ
সৃষ্টি হয়। ভারতের বৃহত্তম দুটি সম্প্রদায় এর ফলে চিনত্মা-চেতনার দিক থেকে
বিভক্ত হয়ে পড়ে।
৬) ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎঃ
বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে কলকাতা কেন্দ্রিক সর্বভারতীয়
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করার সুযোগ লাভ করে। বঙ্গভঙ্গের ফলে সকল পেশাগত
শ্রেণী আর্থিকভাবে ৰতিগ্রসত্ম হয়।
(মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
No comments:
Post a Comment