‘গভর্নেন্স' (Governance) একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ,
ক্ষেত্র এবং প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গভর্নেন্সকে রাজনৈতিক
ব্যবস্থায় ‘শাসনের ব্যবস্থা' হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ‘গভর্নেন্স'
প্রপ্রঞ্চটির সাথে ‘সু' প্রত্যয় যোগ করে ‘সুশাসন' (Good Governance)
শব্দটির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। এর ফলে সুশাসনের অর্থ দাঁড়িয়েছে নির্ভুল,
দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। তবে সুশাসনকে একক কোনো ধারণার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত বা
ব্যাখ্যা করা যায় না। কেননা সুশাসনের ধারণাটি হলো বহুমাত্রিক। বিভিন্ন
তাত্ত্বিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা সুশাসন ধারণাটির (Concept)
সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। 'সুশাসন' ধারণাটি বিশ্ব ব্যাংকের
উদ্ভাবিত একটি ধারণা। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষায়
সর্বপ্রথম ‘সুশাসন' (Good Governance) প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। এতে
উন্নয়নশীল দেশের অনুন্নয়ন চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয় যে, সুশাসনের
অভাবেই এরূপ অনুন্নয়ন ঘটেছে।
সুশাসন (GOOD GOVERNANCE): ম্যাককরনী
(Mac' Corney) বলেছেন যে, ‘সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের,
সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়।'
মোটকথা, প্রশাসনের যদি জবাবদিহিতা (Accountability), বৈধতা (Legilimacy),
স্বচ্ছতা (Transparency) থাকে, এতে যদি অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে,
বাকস্বাধীনতাসহ সকল রাজনৈতিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ব্যবস্থা, বিচার বিভাগের
স্বাধীনতা, আইনের অনুশাসন (Rule of law), আইনসভার নিকট শাসন বিভাগের
জবাবদিহিতা বা দায়িত্বশীলতার নীতি কার্যকর থাকে তাহলে সে শাসনকে ‘সুশাসন'
(Good Governance) বলে।
একটি আধুনিক ধারণা হিসেবে 'সুশাসন'
প্রতিষ্ঠার পথে রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা বা বাধা। তবে সরকার ও জনগণের যৌথ
প্রচেষ্টায় এসব সমস্যার সমাধান করে বা বাধা পেরিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা
সম্ভব।
শাসন ও সুশাসনের ধারণা ও সংজ্ঞা (Concept of Governance and
Good Governance): পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র মানব সভ্যতার বিবর্তনের ফসল।
যুগের পর যুগ ও বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদানের সমন্বয়ে
এসবের উদ্ভব ঘটেছে। এসব সংগঠন গড়ে উঠেছে মানব জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা
প্রদানের জন্য। এ সকল সংগঠনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও আচরণ
নিয়ন্ত্রণের জন্য একসময় শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আদিতে সমাজ ও রাষ্ট্র
ব্যবস্থায় শাসন প্রবর্তনের মূল লক্ষ্য ছিল জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
মনুসংহিতায় লক্ষ্য করা যায় যে, রাজা প্রজাদের নিকট থেকে উৎপন্ন ফসলের ছয়
ভাগের এক ভাগ রাজস্ব আদায় করতো। এর বিনিময়ে রাজা প্রজাদের নিরাপত্তা
বিধান করতো। প্লেটো, এরিস্টটল, ইবনে খালদুন প্রমুখ দার্শনিক ও
রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিশ্বাস করতেন যে, উত্তম জীবন গড়ে তোলার জন্যই
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব' (The State exists to Promote good life.।
১৯১৭
খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটলে
রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও দায়-দায়িত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। ১ম ও ২য়
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্যা ও জটিলতা বৃদ্ধি
পেলে তা নিরসনকল্পে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতেও জনকল্যাণের বিষয়টি গুরুত্বের
সাথে বিবেচিত হতে থাকে। বৃদ্ধি পেতে থাকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের (Welfare
state) ধারণা। এরপর থেকে আধুনিক রাষ্ট্র ‘জনগণের বন্ধু, দার্শনিক ও
পরিচালকে' (Friend, Philosopher and Guide) পরিণত হয়। বর্তমানে জনকল্যাণই
রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হয়। এজন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে
সুশাসনের ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে তথ্যের সহজলভ্যতার পাশাপাশি
জনগণের সচেতনতা ও দক্ষতা, সুশাসনের প্রয়োজনীয়তাকে আবশ্যকীয় করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাংক
ও UNDP-এর মতে, সুশাসনের মাধ্যমেই একটি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহকে প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের
অধিকার ভোগ করতে পারে। এছাড়াও একটি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সে
রাষ্ট্রে টেকসই উন্নয়ন সাধিত হয়। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের
বিকাশের জন্যও প্রয়োজন সুশাসন। এজন্যই 'সুশাসন' বিষয় সম্পর্কিত তাত্ত্বিক
মিশেল ক্যামডেসাস (Michel Camdessus) বলেছেন যে, ‘রাষ্ট্রের সব ধরনের
উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক' (Good Governance is important for
countries at all stages of development)। জাতিসংঘের আফ্রিকা অঞ্চলের বিশেষ
উপদেষ্টা ইব্রাহিম গানবারি সুশাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন
যে, ‘যে সমস্ত রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শুধুমাত্র সে সমস্ত দেশেই
ঋণ মওকুফ করা হবে'।
শাসন (Governance): Good Governance বা সুশাসন
সম্পর্কে আলোচনার আগে জানা প্রয়োজন ‘শাসন' বা শাসনের ব্যবস্থা' বা
‘Governance' বলতে কী বোঝায়। 'গভর্নেন্স' একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ক্ষেত্র এবং প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ
কারণে তাত্ত্বিকদের মধ্যে ‘গভর্নেন্স' বিষয়ে সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রেও
পার্থক্য লক্ষ করা যায়৷
'গভর্নেন্সকে' রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসনের
ব্যবস্থা' হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ল্যান্ডেল মিলস এবং সেরাজেল্ডিন (Landell
Mills and Serageldin)-এর মতে, "জনগণ কীভাবে শাসিত হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয়
বিষয়াদি পরিচালিত হয়, কীভাবে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় এবং একই সাথে এ
সকল প্রক্রিয়া কীভাবে লোকপ্রশাসন ও আইনের সাথে সম্পর্কিত সে বিষয়কেই
‘গভর্নেন্স' বলে"।
The Oxford English Dictionary-তে শাসনের
প্রক্রিয়া, শাসনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং নিয়ন্ত্রণের
ব্যবস্থা হিসেবে গভর্নেন্সকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯৯৪ সালে বিশ্ব
ব্যাংক প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, ‘সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি
দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের
পদ্ধতিই হলো গভর্নেন্স।'
হালফ্যানি (Halfani) ও অন্যান্য গবেষকগণ
সহমত পোষণ করে বলেন যে, ‘গভর্নেন্স হলো সরকারের এমন এক ব্যবস্থা যার লক্ষ্য
কেন্দ্রীভূত থাকে রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের মধ্যে বৈধ সম্পর্ক ও উন্মুক্ত
যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং সে সাথে কার্যকরী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান
নির্মাণ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, নির্বাচনি প্রক্রিয়া স্থাপন এবং
প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল সরকারি কাঠামোকে ক্রিয়াশীলকরণ।'
অধ্যাপক
মাহাবুবুর রহমান-এর মতে, “শাসন হলো এমন একটি ধারণা যেখানে কর্তৃপক্ষ
উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করে”
(Governance is such a concept Ag authorities exercise for the
organizational management to sustain development)।
ডি. কউফম্যান ও
অন্যরা (D. Kaufmann & others) মনে করেন যে, যে প্রক্রিয়ায় শাসকবর্গ
নির্বাচিত হন, জবাবদিহি করেন, নিরীক্ষিত ও পরিবর্তিত হন; সম্পদের
ব্যবস্থাপনায় সরকারি দক্ষতা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ধারিত হয়
এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা বিবেচিত হয় তাকেই
গভর্নেন্স বলে।
সুশাসন (Good Governance): 'গভর্নেন্স' প্রপঞ্চটির
সাথে 'সু' প্রত্যয় যোগ করে 'সুশাসন' (Good Governance) শব্দটির প্রকাশ
ঘটানো হয়েছে। এর ফলে ‘গভর্নেস্’-এর নরমেটিভ উপাদানের প্রকাশ ঘটেছে। এর ফলে
সুশাসনের অর্থ দাঁড়িয়েছে নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। ২০০০ সালে
বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করে যে, সুষ্ঠু গভর্নেন্স বা সুশাসন চারটি প্রধান
স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল। এ চারটি স্তম্ভ হলো- ১. দায়িত্বশীলতা ২.
স্বচ্ছতা, ৩. আইনি কাঠামো, ও ৪. অংশগ্রহণ।
সুশাসনকে একক কোনো ধারণার
মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত বা বিশ্লেষণ করা যায় না। কেননা সুশাসনের ধারণাটি হলো
বহুমাত্রিক। বিভিন্ন তাত্ত্বিক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা
'সুশাসন' ধারণাটির সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
তারা 'সুশাসন'
ধারণাটি বিশ্বব্যাংকের উদ্ভাবিত একটি ধারণা। একটি উন্নয়ন সহযোগী
প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক সর্বপ্রথম উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ‘সুশাসন'
ধারণাটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাংকের এক
সমীক্ষায় সর্বপ্রথম ‘সুশাসন' প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। এতে উন্নয়নশীল
দেশের অনুন্নয়ন চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয় যে, সুশাসনের অভাবেই এরূপ
অনুন্নয়ন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, সুশাসন নিশ্চিতকরণের জন্য যেসব শর্ত রয়েছে
তা' পূরণের শর্তে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ঋণ সাহায্য ও
প্রকল্প সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
সুশাসনের সংজ্ঞা
(Definition of Good Governance): সুশাসনকে একক কোনো ধারণার মাধ্যমে
সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কেননা সুশাসনের ধারণাটি বহুমাত্রিক। তবে এরপরও
বিভিন্ন তাত্ত্বিক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা 'সুশাসন'
ধারণাটির সংজ্ঞা প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। এগুলো নিম্নরূপঃ
বিশ্ব
ব্যাংক (World bank)-এর মতে, “সুশাসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে
উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য
ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়” (Good Governance is a manner in which power is
exercised in the management of a country's economic and social resources
for development.)।
পিয়েরে ল্যান্ডেল মিলস্ এবং ইসমাইল
সেরাজেলডিন (Pierre Landell, Mills and Ismail Serageldin) তাদের লিখিত
‘Governance and the Eternal Factor' নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বলেছেন যে,
“গভর্ন্যান্স বলতে বোঝায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার
ব্যবহার যা একটি রাষ্ট্রকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যার মধ্যে
অন্তর্ভুক্ত থাকে জনগণের সুষ্ঠু চাহিদা ও তাদের বৈধ অধিকার উপভোগের
বাধ্যবাধকতা।”
অধ্যাপক ড. মহব্বত খান-এর মতে, “সুশাসন হলো একটি
দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা। তবে ব্যবস্থাটি
হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায্য সমতাপূর্ণ।”
UNDP-এর
মতে, “একটি দেশের সার্বিক স্তরের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক,
রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চর্চার বা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো
সুশাসন” (Good Governance is the exercise of economic, Political and
administrative authority to manage a country's affairs at all levels.)।
জাতিসংঘের
সাবেক মহাসচিব কফি আনান (Kofi Annan) বলেছেন, “সুশাসন মানবাধিকার এবং
আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে,
জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতাকে প্রবর্তন করে"।
ভি. কে. চোপড়া
(V. K. Chopra) বলেন, “সুশাসন হলো শাসনের একটি পদ্ধতি যা সমাজের মৌলিক
মূল্যবোধগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করতে সমর্থ, সেখানে মূল্যবোধগুলো
হচ্ছে মানবাধিকারসহ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ক এবং
একটি দায়বদ্ধ ও সৎ প্রশাসনের মাধ্যমে এই মূল্যবোধগুলো অন্বেষণ করা” (Good
governance is a system of governance that is able to Unambiguously
identify the basic values of the society where values are economic,
political and socio-culture issues including human rights and pursue
these values through and accountable and honest administration.)।
জি.
বিলনে (G. Bilney)-এর মতে, “Good Governance is the effective management
of a country's Social and economic resources in a manner that is open,
transparent, accountable and equitable."
মারটিন মিনোগের মতে,
“বৃহৎ অর্থে সুশাসন হচ্ছে কতিপয় উদ্যোগের সমাহার ও একটি সংস্কার কৌশল যা
সরকারকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য
সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলে।”
The Social
Encyclopaedia তে সুশাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “এটি সরকার পরিচালনা
অপেক্ষা একটি বিস্তৃত ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সামাজিক
নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয়
কর্তৃপক্ষের ভূমিকার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।” (It is a broader concept
than Government, which is specially concerned with the role of Political
authorities in maintaining social order within a defined territory and
the exercise of executive power)।
'সুশাসন' সম্পর্কে একটি সুন্দর ও
গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ম্যাককরনী (MacCorney)। তার মতে, 'সুশাসন
বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের
সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়' (Good governance is the relationship
between civil society and the state, between government an governed, the
ruler and ruled)।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা (Obstacles or Problems of Good Governance):
বর্তমান সময়ে প্রায় সব রাষ্ট্রই 'কল্যাণকর রাষ্ট্রের' (Welfare State )
রূপ পরিগ্রহ করছে। এরূপ কল্যাণকর রাষ্ট্রে জনগণের কল্যাণ ও ব্যক্তিসত্তার
পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। দমন ও নিপীড়নের মাধ্যমে
মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করার দিন বদলে গেছে। শাসনের
সাথে সেবা প্রদানের বিষয়টি এখন গুরুত্ব লাভ করেছে। একটি রাজনৈতিক
ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা কখনো আকস্মিকভাবে ঘটানো
যায় না। একে অর্জন করতে হয় ধাপে ধাপে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য
চাপ দিচ্ছে। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও রয়েছে বহু সমস্যা। এগুলো
নিম্নরূপঃ
১. বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপঃ অধিকাংশ রাষ্ট্রেই, বিশেষ
করে অনুন্নত, উন্নয়নশীল, ও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে তত্ত্বগতভাবে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও দেখা যায় যে, জনগণের বাক স্বাধীনতায়
ক্ষমতাসীন সরকার হস্তক্ষেপ করে থাকে। জনগণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে
না। সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার ওপর সরকার সেন্সরশীপ আরোপ করে। সরকার সব সময়
মুক্ত আলোচনাকে ভয় পায় এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে জনগণ
রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে পারে না। এর ফলে সুশাসন
বাধাগ্রস্ত হয়।
২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং সহিংসতা (Lack
of Political Stability and Violence): সদ্য স্বাধীন, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল
বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব লক্ষ করা যায়।
নির্বাচিত সরকার নির্ধারিত মেয়াদ শেষের আগেই বিরোধী দলগুলো সরকার পতনের
আন্দোলন শুরু করে। এসব আন্দোলন হয়ে ওঠে সহিংস। অকারণে ‘হরতাল' বা 'বন্ধ'
ঘোষণা এবং পিকেটিং, জ্বালাও-পোড়াও করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। ফলে সময়ের
আগেই সরকারের পতন ঘটে কিংবা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এর ফলে উন্নয়ন ব্যাহত
হয়। প্রশাসন ভেঙে পড়ে বা স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে সুশাসন ব্যাহত হয়।
৩.
সরকারের জবাবদিহিতার অভাব (Lack of Accountability of the Govt.): অনুন্নত
ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে এমনকি কোনো কোনো উন্নত রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার
অভাব লক্ষ করা যায়। লক্ষ করা যায় যে, সরকারের শাসনবিভাগ তাদের কাজের জন্য
আইন বিভাগের নিকট জবাবদিহি করে না । মন্ত্রী ও আইন সভার সদস্যগণ একই দলের
হওয়ায় এবং দলীয় শৃঙ্খলার কারণে জবাবদিহিতার বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে
পড়ে। এর ফলে সুশাসন বিঘ্নিত হয়।
৪. আমলাদের জবাবদিহিতার অভাব
(Lack of Accountability of the Bureancrats): সাধারণত আমলারা নিজেদেরকে
জনগণের সেবক না ভেবে প্রভু ভাবেন। তারা নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণি বলে মনে
করেন। তাদের মধ্যে জবাবদিহিতার মানসিকতা গড়ে না ওঠায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা
সুদূর পরাহত হয়ে ওঠে। এজন্যই রিচার্ড ক্রসম্যান বলেছেন যে, “অনিয়ন্ত্রিত
আমলাতন্ত্র গণতন্ত্রের জন্য হুমকীস্বরূপ” (An uncontrolled bureancracy is a
threat to democracy')।
৫. আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা (Inefficiency of
the Bureancracy): আমলাতন্ত্রে পূর্বের মতো দক্ষ, নিরপেক্ষ ও মেধাবী মুখ
দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার প্রাধান্য,
প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, আমলাদের কাজে অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ,
রাজনীতিকরণ ইত্যাদি কারণে আমলারা ক্রমশ অযোগ্য ও অদক্ষ হয়ে পড়ছে। ফলে
সুশাসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
৬. আইনের শাসনের অভাব (Absence of Rule of
Law): অধ্যাপক ডাইসি-এর মতে, আইনের শাসনের মৌলিক তিনটি শর্ত রয়েছে। এগুলো
হলো ক. আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান, খ. আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান
থাকা, গ. শুনানী গ্রহণ ব্যতীত কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না
করা। এই শর্ত তিনটি মেনে চললেই তবে বলা যাবে যে, আইনের শাসন কার্যকর
রয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ন্যায়পরায়ণ আচরণ, নিপীড়ন
মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ ও নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হয়। কিন্তু
অনেক রাষ্ট্রেই এরূপ অবস্থা বিদ্যমান নেই।
৭. সরকারের অদক্ষতা ও
অব্যবস্থাপনা (Inefficiency and Mismanagement of Govt.): অনেক রাষ্ট্রেই
দক্ষ ও যোগ্য সরকার সব সময় দেখতে পাওয়া যায় না। সরকারের অদক্ষতা ও
অব্যবস্থাপনা কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশে অরাজকতা চলতে দেখা যায়। এর
ফলে সুশাসন ব্যাহত হয়। যথার্থ নীতি প্রণয়নে সরকারের দক্ষতা, সঠিক সময়ে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা' শক্ত হাতে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, সমান সেবা
বিতরণ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তৎপর
হওয়া, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা ইত্যাদি হলো কার্যকর সরকার বা দক্ষ
সরকারের বৈশিষ্ট্য। এগুলোর অভাব ঘটলেই ধরে নিতে হবে সে দেশের সরকার
অকার্যকর।
৮. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা (Failure to Control
Corruption): বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সুশাসনের বড় অন্তরায় হলো
দুর্নীতি। দুর্নীতির রাহুগ্রাস এসব রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে
ফেলছে। দুর্নীতির কারণে সম্পদের অপচয় হয়, বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি হয় এবং
আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। UNCAC-এর ভূমিকায় বলা হয়েছে যে, “দুর্নীতি সমাজ ও
রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। কারণ এর মাধ্যমে
ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা বিনষ্ট হয়, ন্যায়বিচার ও সবার সমান
অধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হুমকির মুখে পড়ে।” অধিকাংশ
রাষ্ট্রেই দুর্নীতি দমন কমিশন বা ব্যুরো নামক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো
স্বাধীন ও কর্মতৎপর নয়।
৯. রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব (Lack of
Political Commitment): সদ্য স্বাধীন, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল ..
রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই
সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। রাজনৈতিক নেতাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকে না,
দলীয় ইশতেহারে যা লেখা থাকে তা বাস্তবায়িত করা হয় না, যে প্রতিশ্রুতি
দিয়ে ক্ষমতায় আসা হয় তা’ পূরণ করার সদিচ্ছা থাকে না, রাজনৈতিক সংস্কৃতি
গঠনে চরম উদাসীনতা দেখানো হয়। যুক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে পেশি শক্তি
প্রদর্শনের প্রবণতা, শাসক ও বিরোধী দলসমূহের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং এর
পরে দেশজুড়ে সৃষ্ট সহিংসতা সমগ্র রাষ্ট্রে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এর ফলে
সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ নষ্ট হয়।
১০. রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে
গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং ব্যক্তিপূজা (Lack of Democratic Culture in
the Political Party): উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অনেক দলে
গণতান্ত্রিক চর্চা নেই ৷ নেতা যা বলেন অধস্তন নেতা-কর্মীরা তা' মেনে নিতে
বাধ্য হন। কেননা তা' না হলে তাকে দলের মধ্যেই কোণঠাসা করে রাখা হয়,
পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করা হয় এমনকি দল থেকেই যেনতেন কারণ দেখিয়ে বহিষ্কার
করা হয়। দলগুলোতে নিয়মিত কাউন্সিল করা হয় না অথবা করা হলেও নির্বাচনের
পরিবর্তে দলীয় নেতার ওপরই পদপদবি বণ্টনের একচ্ছত্র ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।
এর ফলে ব্যক্তিপূজা অর্থাৎ একক ব্যক্তির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়
এবং দলে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় । নেতা স্বৈরাচারী মনোভাবের
অধিকারী হন। এরূপ স্বৈরাচারী নেতা ক্ষমতায় গিয়ে যে আচরণ করেন, যেভাবে দেশ
পরিচালনা করেন তার ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকে না।
১১.
রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ (Military intervention in Politics): অনুন্নত ও
উন্নয়নশীল বিশ্বে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক
রাষ্ট্রেই রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ-এর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সামরিক
শাসনামলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, গণতান্ত্রিক
প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয় বা অকার্যকর করে রাখা হয়। এর ফলে
সুশাসন প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে।
১২.
স্বজনপ্রীতি-(Napotism): বিশ্বের অনেক দেশেই স্বজনপ্রীতির ব্যাপক বিস্তার
লক্ষ করা যায়। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, সুযোগ-সুবিধা বণ্টন,
সম্মান-পদবি-খেতাব প্রদান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকার বা গোষ্ঠী
স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিদের সেবা ও
সহযোগিতা থেকে রাষ্ট্র তথা প্রশাসক বঞ্চিত হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার
পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
১৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকা (Absence
of Independence of judiciary): স্বাধীন বিচার বিভাগ সুশাসন প্রতিষ্ঠার
জন্য সহায়ক। স্বাধীন বিচার বিভাগ না থাকায় বা বিচার বিভাগে রাজনৈতিক
হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুযোগ বিনষ্ট
হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শেষ সুযোগটুকুও হাতছাড়া হয়।
১৪.
জনঅংশগ্রহণের অভাব (Lack of People's Participation): প্রশাসনে ব্যাপক
জনগণের অংশগ্রহণের বা মতামত প্রদানের সুযোগের অভাব, জনগণের সাথে প্রশাসনিক
সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের অভাব, গণমুখী প্রশাসন গড়ে
তোলার অভাব, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর
না করা প্রভৃতির ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।
১৫.
অকার্যকর জাতীয় সংসদ (Disfunctional Parliament): গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থায়, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভার গুরুত্ব অপরিসীম।
আইনসভা প্রণীত আইনের আলোকেই একটি দেশের প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়।
আইনসভার সদস্যগণ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তারা
জাতীয় সংসদে তুলে ধরবেন, সরকারের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করবেন এবং সমাধান
নির্দেশ করবেন। কিন্তু অনেক দেশে আইনসভা দুর্বল। অনেক দেশে শাসন বিভাগের
স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেক দেশে বিরোধী
দলীয় সদস্যগণ আইনসভা বয়কট করে রাজপথে আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্যগণ সংসদ বর্জন করে
চলেছেন। যখনই যে দল বিরোধী দলের আসনে বসেন—সে দল বা জোটই সংসদ বর্জন করে
রাজপথে মিছিল-মিটিং-হরতাল এমনকি জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস পথে অগ্রসর
হন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সকল সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে সংসদে বসে,
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। ফলে জাতীয় সংসদ অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে
চলেছে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথও প্রশস্ত হচ্ছে না।
১৬.
দারিদ্র্য (Poverty ): দারিদ্র্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা।
আর্থিক কারণে দরিদ্র জনগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। দরিদ্র ও অশিক্ষিত
জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। দরিদ্র ও অসচেতন জনগণ সুশাসন
প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন থাকে। সুতরাং দারিদ্র্য সুশাসন
প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা।
১৭. স্থানীয় সরকার কাঠামোর দুর্বলতা
(Weakness of Local Government): সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হলো
শক্তিশালী, দক্ষ ও কার্যকর স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা।
কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ
সৃষ্টি হয় এবং নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রেই, বিশেষ করে
সদ্য স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে স্থানীয় সরকার কাঠামো খুবই দুর্বল
ও অকার্যকর। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
১৮. জনসচেতনতার
অভাব (Absence of Peoples awareness): জনগণের সচেতনতাই গণতন্ত্রের সফলতার
মূল শক্তি। জনগণের সজাগ দৃষ্টি নাগরিক অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ।
এজন্যই জনসচেতনতা সুশাসনেরও চাবিকাঠি। জনগণ সচেতন না হলে সরকার,
প্রশাসনযন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এর ফলে 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার পথে
অন্তরায় সৃষ্টি হয়।
১৯: ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব (Absence of
Balance of Power): সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারের এক বিভাগ কর্তৃক
অন্য বিভাগের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এর
ফলে সরকারের কোনো বিভাগের পক্ষে স্বেচ্ছাচারী এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ
করার প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হবে। কিন্তু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর
খুব কম রাষ্ট্রই এরূপ ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি কার্যকর রয়েছে। এর ফলে অনেক
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে 'সুশাসন' বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২০. স্বাধীন ও
নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অভাব (Absence of Free & Neutral Election
Commission): অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নির্বাচন কমিশন থাকলেও তা স্বাধীন
বা প্রভাবমুক্ত এবং নিরপেক্ষ নয়। অনেক সময় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও
নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও পারেন না। এর ফলে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ
নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠাও বাধাগ্রস্ত
হয়।
২১. সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব (Absence of Freedom of
Press): সুশাসনের জন্য প্রয়োজন স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম। স্বাধীন
সংবাদ মাধ্যম ছাড়া মানবাধিকার রক্ষা, মৌলিক অধিকার উপভোগের অনুকূল পরিবেশ
রক্ষা, জবাবদিহিতার নীতি কার্যকর করা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
সম্ভব নয়। অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সংবাদপত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়।
এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়।
২২. সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতির অভাব (Lack of Communal Harmony): সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না
থাকলে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা সফল করা সম্ভব নয়। কেননা
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে জঙ্গীবাদ, উগ্রতা, হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবে জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়
এবং মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়
সৃষ্টি হয়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা সমাধানের উপায় (Measures to remove the problems
of good governance): সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য
নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেঃ
১. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের
সন্নিবেশ ও তা বাস্তবায়নঃ বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার
সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে হবে। শুধু তাই নয় এগুলো যেন কেউ
ব্যক্তিস্বার্থে বা ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে খর্ব করতে না পারে সেজন্য
কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমের ওপর
সরকারি হস্তক্ষেপের অবসানঃ অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অকারণে ও সম্পূর্ণ ক্ষুদ্র
দলীয় স্বার্থে সরকার মিডিয়া ও প্রচার যন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জনমত গঠনের সুযোগ নষ্ট হয়, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা
ক্ষুণ্ণ হয়। সরকার আরো স্বৈরাচারী হয়। এ জন্য মিডিয়া ও প্রচার যন্ত্রের
ওপর সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।
৩. সহিংসতা দূর ও
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাঃ রাজপথে সহিংস আন্দোলন করে, জ্বালাও
পোড়াও নীতি অবলম্বন করে, অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত হরতাল সংস্কৃতি চালু
রেখে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজার কু-অভ্যাস বদলাতে হবে। জাতীয় সংসদে
বসে এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়েই রাজনৈতিক
সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সরকারের বিরোধিতার জন্য হরতালের বিকল্প উপায়
খুঁজে বের করতে হবে। নির্বাচিত সরকারকে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরানোর আশ্রয়
নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সুশাসনের অন্তরায়।
৪.
জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতার নীতি প্রতিষ্ঠাঃ রাষ্ট্র পরিচালক বা সরকার থেকে
শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতার নীতি প্রতিষ্ঠা
করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে কার কি দায়িত্ব এবং কোন্ সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন
করতে হবে, কার নিকট জবাবদিহি করতে হবে তা পূর্বেই নির্ধারণ করতে হবে। শাসন
বিভাগ বা মন্ত্রিসভাকে আইনসভার নিকট তাদের গৃহীত নীতি, সিদ্ধান্ত ও কাজের
জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তা করতে ব্যর্থ হলে আইনসভায় অনাস্থা এনে
মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থা বিধান করতে হবে। প্রশাসনিক
কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যাবে সেকথাও পরিষ্কার করে
উল্লেখ থাকতে হবে।
৫. স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তোলাঃ শাসন বা
গভর্নেন্স-এর লক্ষ্য হবে স্পষ্ট, হীরকের মত স্বচ্ছ। শাসনের স্বরূপ, শাসকের
কাজকর্ম, প্রণীত আইন-কানুন এমন হতে হবে যেন তা সকল নাগরিকের বোধগম্য হয়।
এগুলো যেন কেউ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে না
পারে সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলতে
হবে।
৬. নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করাঃ মানুষ সরকার এবং রাষ্ট্র প্রণীত
আইন মেনে চলে শুধু শাস্তির ভয়ে নয়। মানুষ বিবেকবোধ, প্রজ্ঞা,
উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ বিচার করেও রাষ্ট্র এবং সরকারকে মেনে চলে। নৈতিক
মূল্যবোধ সরকার এবং সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের
সুকুমার বৃত্তিগুলোকে পরিশীলিত করে। নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক
কর্তৃপক্ষ ও আমলা-প্রশাসকগণের আচরণ সীমা লংঘন করে না। তারা আইন অনুযায়ী,
সংবিধান অনুযায়ী কাজ করেন। তারা সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তারা
দুর্নীতিতে লিপ্ত হন না।
৭. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাঃ আইনের শাসনের
প্রাণভোমড়া তিনটি প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। এগুলো হলো শাসকের
ন্যায়পরায়ণ আচরণ, নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশে ও আইনের শাসন প্রয়োগের
উপযুক্ত পরিবেশ। আইন হতে হবে নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট যেন সহজেই তা বোধগম্য হয়
এবং সবাই তা পালন করতে বা মেনে চলতে পারে। আইন কার্যকর করবে আদালত। কোনো
ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী বিচার কাজ চলবে না, তা চলবে আইনের আলোকে।
৮.
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণঃ বিচার বিভাগকে আইন ও
শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও
নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে
হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। জেলা ও অধঃস্তন আদালতগুলোর
বিচারক নিয়োগ করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে।
৯.
সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধিঃ সরকারকে দক্ষ, দূরদর্শী ও কার্যকর ভূমিকা পালনে
সক্ষম হতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যের সহজলভ্যতা সৃষ্টি করতে হবে,
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব
প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১০. দুর্নীতি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণঃ
দুর্নীতির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে হবে। দুর্নীতি বিরোধী
সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে। এজন্য সুশীল সমাজের সৎ মানুষদের
নিয়ে 'দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি' গঠন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে
দুর্নীতি বিরোধী আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে সিলেবাসে দুর্নীতি
বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়াও নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয়
অনুশাসন দ্বারা-জনগণের মনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিকে ঘৃণা করার মানসিকতা
বৃদ্ধি করতে হবে।
১১. সুযোগ্য নেতৃত্বঃ দক্ষ, সৎ, দূরদর্শী, অভিজ্ঞ,
ন্যায়পরায়ণ, জনদরদি বা জনবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষিত,
সৎ ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের অভাবে একটি রাষ্ট্র কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করতে
পারে না।
১২. সার্বভৌম ও কার্যকর আইনসভাঃ আইনসভার সার্বভৌমত্ব শুধু
তত্ত্বকথায় যেন পর্যবসিত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সকল
সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে—আইনসভায় বসে যুক্তিতর্ক পেশ করে, আলাপ-আলোচনার
মাধ্যমে। আইনসভাকে বাদ দিয়ে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবিদাওয়া আদায়ের
কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। অকারণে, ঘন ঘন সংসদ বয়কট বা এখান থেকে ওয়াকআউট
করা যাবে না। সংসদে অনুপস্থিত থাকার সময়সীমা কমাতে হবে৷ সকল সদস্যের বিশেষ
করে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের আলোচনার সুযোগ দিতে হবে।
১৩. জন
অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিঃ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে
তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বনির্ভর ও স্ব-শাসিত করার জন্য
যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নীতি প্রণয়নে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা
বৃদ্ধি করতে হবে।
১৪. স্বাধীন কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠাঃ জনপ্রশাসনে
নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে হবে। এজন্য
নিরপেক্ষ, সৎ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সমন্বয়ে কর্মকমিশন গঠন করতে হবে।
১৫.
স্বাধীন নির্বাচন কমিশনঃ রাজনৈতিক দল গঠন ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনয়ন
করতে হবে। দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র
চর্চা, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন
করতে হবে।
১৬. স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠনঃ মানবাধিকার লংঘন যেন
না হয়, কারো ওপর যেন জুলুম-নির্যাতন না করা হয়, সরকার যেন
অন্যায়-নির্যাতন না করতে পারে—তা দেখার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করতে
হবে।
১৭. জনস্বার্থকে প্রাধান্য প্রদানঃ সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর
সার্বিক কল্যাণ সুশাসনের লক্ষ্য হওয়ায় এ প্রক্রিয়ায় জনগণের সম্পৃক্ততা
অপরিহার্য। এ অংশগ্রহণ সম্ভবপর হয় যখন গভর্ন্যান্স উক্ত জনগণের স্বার্থ
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিণত হয়।
১৮. লক্ষ্য নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার
বিবেচনায় পারঙ্গমতাঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং
অগ্রাধিকার বিবেচনায় পারঙ্গম ও দূরদর্শী হতে হবে।
১৯. দারিদ্র্য দূরীকরণঃ দারিদ্র্য দূরীকরণে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২০.
স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালীকরণঃ স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে
হবে। স্থানীয় সরকারকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি এর উপর থেকে
সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে হবে।
২১. জনসচেতনতা বৃদ্ধিঃ সুশাসন
কী, কীভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে, এক্ষেত্রে জনগণ ও সরকারের কী করণীয়
সে সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২২.
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে
হবে। এজন্য মৌলবাদী, জঙ্গী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা
নস্যাৎ করতে হবে।
২৩. ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাঃ সরকারের বিভিন্ন
বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য লর্ড অ্যাক্টন
বলেছেন যে, ‘ক্ষমতা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় এবং নিরংকুশ ক্ষমতা
দুর্নীতিকেও নিরংকুশ করে তোলে'। Power Corrupts, absolute Power tends to
corrupt absolutely.)
শাসন ও সুশাসনের ধারণা, সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা এবং সমস্যা সমাধানের উপায় -- মোঃ হেলাল উদ্দিন
No comments:
Post a Comment