Monday, September 16, 2024

সাম্য কী? সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্ব আলােচনা কর।

 ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য সম্পর্কিত আলােচনা সর্বকালের একটি বহুল আলােচিত বিষয়। প্রাচীনকালের গ্রিক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত সকলেই সাম্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুগে যুগে মানুষ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে শামিল হয়েছে। সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য মানুষের আত্মত্যাগের নজির ইতিহাসে অসংখ্য।

সাধারণ অর্থে সাম্যঃ সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বুঝায় সকল মানুষই সমান। তাই প্রত্যেকে সমান সুযােগ-সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করবে। বাস্তবে মানুষে মানুষে শারীরিক, মানসিক গঠন ও গুণগত যােগ্যতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। রাষ্ট্র যদি একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও একজন সাধারণ শ্রমিককে এই মূল্যায়ন করে, তাহলে সমাজে প্রতিভার বিকাশ হবে না। কিন্তু বর্তমানে চতুর্দিকে সাম্যের জয়গান শােনা যায়। তবে এ সাম্য ভিন্ন অর্থে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ সাম্যের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। একেকজন একেকভাবে সাম্যের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন-

প্রফেসার লাস্কি (Prof. Laski) মনে করেন- "It means that no man shall be placed in a society that he can overreach his neighbor to the extent which constitutes a denial of the latter citizenship.(সাম্য হলাে সেরূপ সুযােগ-সুবিধার ব্যবস্থা যাতে কোনাে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অন্যের ব্যক্তিগত সুবিধার বেদীমূলে আত্মবিসর্জন দিতে না হয়।)

অধ্যাপক বার্কার (Prof. Barker) বলেন, 'সাম্য বলতে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সকলের সুযােগ-সুবিধার সমতাকে বলা হয়। কিন্তু এর ফলে সকলের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে।

অধ্যাপক পিট্রিম সরােকিন (Pitrim Sorokin)-এর মতে, "Equality means equal distribution of ends, means and object to reach humanity apex to exposure." (মানবতার চরম উৎকর্ষসাধনের জন্য ব্যক্তিস্বার্থসমূহের বণ্টন প্রক্রিয়াকে সাম্য বলে।)

উপযুক্ত সংজ্ঞার আলােকে বলা যায়, সাম্য বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান সুযােগ-সুবিধা প্রদান করা হয়।

সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্বঃ আধুনিক সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা যেমন একটি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য তেমনি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সফলতার জন্য সাম্য অপরিহার্য। নিম্নে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলাে-

(১) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেঃ গণতন্ত্রের এক ধরণের অর্থসামাজিক বিষয়। সামাজিক গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে সমাজে মানুষে মানুষে উচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভেদাভেদ না থাকা। সুতরাং সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(২) ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায়ঃ সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সাম্য স্বাধীনতার পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা ভােগ করা যায় না। কারণ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকলে সবল ব্যক্তিরা দুর্বলদের ওপর হস্তক্ষেপ করে। তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

(৩) সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠায়ঃ সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্যও সাম্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে বিরাট অসাম্য থাকলে শান্তি ব্যাহত হয়। কারণ অতি দরিদ্র মানুষেরা জীবিকার তাগিদে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই প্রভৃতি সমাজ বিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

(৪) সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ঃ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে অসাম্য সৃষ্টি হলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবােধ হ্রাস পায়। ফলে মানুষের প্রতিও মানুষের আস্থা হ্রাস পায়। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালােবাসা সৃষ্টিতে সাম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

(৫) নৈতিক মান উন্নয়নেঃ সাম্যবাদী রাষ্ট্রে মানুষের অর্থ উপার্জনের স্বার্থপর প্রয়াস না থাকায় তাদের নৈতিক গুণাবলী উন্নত হয়। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের চরিত্রের খারাপ দিকগুলাে পরিত্যাগ করে আদর্শনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

(৬) আয় ও সম্পদের সমবন্টনেঃ সাম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আয় ও সম্পদ প্রভূত বৈষম্য বিরাজ করে। ফলে ধনী ও দরিদ্র এ দু'শ্রেণীতে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ধনীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে ও দরিদ্ররা দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করে। কিন্তু সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সকল সম্পদের ভােগ জনগণ সমানভাবে করতে পারে।

(৭) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায়ঃ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ সাম্য ব্যতীত সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। অর্থনৈতিক সাম্য না হলে সমাজে আয়ের বৈষম্য ও ধনবৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষের কর্মের অধিকার ও জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা যায় না।

(৮) নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়ঃ সকল নাগরিক যাতে সমান রাজনৈতিক অধিকার ভােগের সুযােগ সুবিধার উপস্থিতি ও সকল নাগরিক যাতে রাষ্ট্রীয় কার্যে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে সাম্যতা নিশ্চিত করে। যেমন প্রত্যেক নাগরিকের ভােটদানের অধিকার, নির্বাচিত হবার অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাম্যের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।

(৯) সামাজিক অধিকার ভােগের নিশ্চয়তাঃ সমাজের সকল সদৃস্য যাতে সমানভাবে সামাজিক অধিকারসমূহ ভােগ করতে পারে, সাম্য তার নিশ্চয়তা প্রদান করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সামাজিক অধিকার সাম্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

(১০) ব্যক্তিত্বের বিকাশসাধনঃ ব্যক্তিত্বের বিকাশসাধনে সাম্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠিত না হলে নৈতিক গুণাবলির মান উন্নয়ন সম্ভবপর হয় না। ফলশ্রুতিতে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশও সম্ভবপর হয় না। সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও নৈতিক মান উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব।

(১১) বৈষম্যের বিলুপ্তি সাধনেঃ সৃষ্টিকর্তা সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেননি। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষে মানুষে ব্যবধান আছে। সমাজে এ প্রকৃতিগত বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে মানুষ সমাজে কৃত্রিম বৈষম্য সৃষ্টি না করে। সাম্যের উপলব্ধিই সমাজে কৃত্রিম বৈষম্যের বিলুপ্তি সাধন করতে পারে।

(১২) সুষ্ঠু আইন প্রণয়নেঃ রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে সমান আচরণ করা উচিত। কারণ আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। সমাজে যাতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনােরূপ বৈষম্য না হয় সেজন্য সাম্যের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। সামাজিক বৈষ্যমের অপসারণ করার জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

(১৩) সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেঃ সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাম্যের বিকল্প নেই। বলা হয়ে থাকে যেখানে সাম্য নেই সেখানে সামাজিক উন্নয়ন সম্ভবপর নয়। তাই সামাজিক উন্নয়নের জন্য সমাজে সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

(১৪) অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্যঃ সমাজের বিভিন্ন প্রকার অন্যায় কাজকে প্রতিহত করার জন্য সাম্য ছাড়া সম্ভবপর হয় না। আর তাই সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সাম্য সর্বদা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা পুরােপুরিভাবে ভােগ করতে হলে সাম্যের উপস্থিতি প্রয়ােজন। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা যথেচ্ছাচারে পরিণত হবে। অপরপক্ষে সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতে হবে। সাম্যনীতি অনুযায়ী সকলের জন্য উপযুক্ত সুযােগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা না করলে, অধিকাংশ লােক স্বাধীনতার সুফল ভােগ করতে পারবে না। কাজেই সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য সম্পর্কিত আলােচনা সর্বকালের একটি বহুল আলােচিত বিষয়। প্রাচীনকালের গ্রিক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত সকলেই সাম্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুগে যুগে মানুষ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে শামিল হয়েছে। সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য মানুষের আত্মত্যাগের নজির ইতিহাসে অসংখ্য।

সাধারণ অর্থে সাম্যঃ সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বুঝায় সকল মানুষই সমান। তাই প্রত্যেকে সমান সুযােগ-সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করবে। বাস্তবে মানুষে মানুষে শারীরিক, মানসিক গঠন ও গুণগত যােগ্যতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। রাষ্ট্র যদি একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও একজন সাধারণ শ্রমিককে এই মূল্যায়ন করে, তাহলে সমাজে প্রতিভার বিকাশ হবে না। কিন্তু বর্তমানে চতুর্দিকে সাম্যের জয়গান শােনা যায়। তবে এ সাম্য ভিন্ন অর্থে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ সাম্যের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। একেকজন একেকভাবে সাম্যের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন-

প্রফেসার লাস্কি (চৎড়ভ. খধংশর) মনে করেন- "ওঃ সবধহং ঃযধঃ হড় সধহ ংযধষষ নব ঢ়ষধপবফ রহ ধ ংড়পরবঃু ঃযধঃ যব পধহ ড়াবৎৎবধপয যরং হবরমযনড়ৎ ঃড় ঃযব বীঃবহঃ যিরপয পড়হংঃরঃঁঃবং ধ ফবহরধষ ড়ভ ঃযব ষধঃঃবৎ পরঃরুবহংযরঢ়.(সাম্য হলাে সেরূপ সুযােগ-সুবিধার ব্যবস্থা যাতে কোনাে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অন্যের ব্যক্তিগত সুবিধার বেদীমূলে আত্মবিসর্জন দিতে না হয়।)

অধ্যাপক বার্কার (চৎড়ভ. ইধৎশবৎ) বলেন, 'সাম্য বলতে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সকলের সুযােগ-সুবিধার সমতাকে বলা হয়। কিন্তু এর ফলে সকলের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে।

অধ্যাপক পিট্রিম সরােকিন (চরঃৎরস ঝড়ৎড়শরহ)-এর মতে, "ঊয়ঁধষরঃু সবধহং বয়ঁধষ ফরংঃৎরনঁঃরড়হ ড়ভ বহফং, সবধহং ধহফ ড়নলবপঃ ঃড় ৎবধপয যঁসধহরঃু ধঢ়বী ঃড় বীঢ়ড়ংঁৎব." (মানবতার চরম উৎকর্ষসাধনের জন্য ব্যক্তিস্বার্থসমূহের বণ্টন প্রক্রিয়াকে সাম্য বলে।)

উপযুক্ত সংজ্ঞার আলােকে বলা যায়, সাম্য বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান সুযােগ-সুবিধা প্রদান করা হয়।

সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্বঃ আধুনিক সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা যেমন একটি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য তেমনি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সফলতার জন্য সাম্য অপরিহার্য। নিম্নে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলাে-

(১) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেঃ গণতন্ত্রের এক ধরণের অর্থসামাজিক বিষয়। সামাজিক গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে সমাজে মানুষে মানুষে উচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভেদাভেদ না থাকা। সুতরাং সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

(২) ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায়ঃ সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সাম্য স্বাধীনতার পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা ভােগ করা যায় না। কারণ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকলে সবল ব্যক্তিরা দুর্বলদের ওপর হস্তক্ষেপ করে। তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

(৩) সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠায়ঃ সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্যও সাম্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে বিরাট অসাম্য থাকলে শান্তি ব্যাহত হয়। কারণ অতি দরিদ্র মানুষেরা জীবিকার তাগিদে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই প্রভৃতি সমাজ বিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

(৪) সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ঃ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে অসাম্য সৃষ্টি হলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবােধ হ্রাস পায়। ফলে মানুষের প্রতিও মানুষের আস্থা হ্রাস পায়। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালােবাসা সৃষ্টিতে সাম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

(৫) নৈতিক মান উন্নয়নেঃ সাম্যবাদী রাষ্ট্রে মানুষের অর্থ উপার্জনের স্বার্থপর প্রয়াস না থাকায় তাদের নৈতিক গুণাবলী উন্নত হয়। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের চরিত্রের খারাপ দিকগুলাে পরিত্যাগ করে আদর্শনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

(৬) আয় ও সম্পদের সমবন্টনেঃ সাম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আয় ও সম্পদ প্রভূত বৈষম্য বিরাজ করে। ফলে ধনী ও দরিদ্র এ দু'শ্রেণীতে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ধনীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে ও দরিদ্ররা দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করে। কিন্তু সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সকল সম্পদের ভােগ জনগণ সমানভাবে করতে পারে।

(৭) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায়ঃ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ সাম্য ব্যতীত সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। অর্থনৈতিক সাম্য না হলে সমাজে আয়ের বৈষম্য ও ধনবৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষের কর্মের অধিকার ও জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা যায় না।

(৮) নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায়ঃ সকল নাগরিক যাতে সমান রাজনৈতিক অধিকার ভােগের সুযােগ সুবিধার উপস্থিতি ও সকল নাগরিক যাতে রাষ্ট্রীয় কার্যে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে সাম্যতা নিশ্চিত করে। যেমন প্রত্যেক নাগরিকের ভােটদানের অধিকার, নির্বাচিত হবার অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাম্যের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।

(৯) সামাজিক অধিকার ভােগের নিশ্চয়তাঃ সমাজের সকল সদৃস্য যাতে সমানভাবে সামাজিক অধিকারসমূহ ভােগ করতে পারে, সাম্য তার নিশ্চয়তা প্রদান করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সামাজিক অধিকার সাম্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

(১০) ব্যক্তিত্বের বিকাশসাধনঃ ব্যক্তিত্বের বিকাশসাধনে সাম্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠিত না হলে নৈতিক গুণাবলির মান উন্নয়ন সম্ভবপর হয় না। ফলশ্রুতিতে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশও সম্ভবপর হয় না। সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও নৈতিক মান উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব।

(১১) বৈষম্যের বিলুপ্তি সাধনেঃ সৃষ্টিকর্তা সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেননি। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষে মানুষে ব্যবধান আছে। সমাজে এ প্রকৃতিগত বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে মানুষ সমাজে কৃত্রিম বৈষম্য সৃষ্টি না করে। সাম্যের উপলব্ধিই সমাজে কৃত্রিম বৈষম্যের বিলুপ্তি সাধন করতে পারে।

(১২) সুষ্ঠু আইন প্রণয়নেঃ রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে সমান আচরণ করা উচিত। কারণ আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। সমাজে যাতে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনােরূপ বৈষম্য না হয় সেজন্য সাম্যের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। সামাজিক বৈষ্যমের অপসারণ করার জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

(১৩) সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেঃ সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাম্যের বিকল্প নেই। বলা হয়ে থাকে যেখানে সাম্য নেই সেখানে সামাজিক উন্নয়ন সম্ভবপর নয়। তাই সামাজিক উন্নয়নের জন্য সমাজে সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

(১৪) অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্যঃ সমাজের বিভিন্ন প্রকার অন্যায় কাজকে প্রতিহত করার জন্য সাম্য ছাড়া সম্ভবপর হয় না। আর তাই সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সাম্য সর্বদা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা পুরােপুরিভাবে ভােগ করতে হলে সাম্যের উপস্থিতি প্রয়ােজন। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা যথেচ্ছাচারে পরিণত হবে। অপরপক্ষে সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতে হবে। সাম্যনীতি অনুযায়ী সকলের জন্য উপযুক্ত সুযােগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা না করলে, অধিকাংশ লােক স্বাধীনতার সুফল ভােগ করতে পারবে না। কাজেই সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।

No comments:

Post a Comment