মূল্যবোধঃ যে চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তাকেই সাধারণত মূল্যবোধ বলা হয়ে থাকে। আর সমাজজীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ড যে নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে।
Stuart C. Dodd বলেন, "সামজিক মূল্যবোধ হলো সে সব রীতি-নীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে।"
এম. ডব্লিউ. পামফ্রে বলেন, "মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি বা সমাজের অভিপ্রেত ব্যবহারের সুবিন্যস্ত প্রকাশ।"
F. E. Meril বলেন, "A social value may be defined as a pattern of belief whose maintenance is considered important to group welfare."
সুতরাং সামজিক মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা মানবীয় গুণাবলির সমষ্টি।
মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্যঃ সামাজিক মূল্যবোধের বেশকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে-
১) সামাজিক মাপকাঠিঃ মূল্যবোধ মানুষের আচার-ব্যবহার, ধ্যান-ধারণা, চাল-চলন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার মাপকাঠি। মূল্যবোধের ভিত্তিতেই মানুষের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।
২) যোগসূত্র ও সেতুবন্ধনঃ মূল্যবোধ সমাজের মানুষকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। একই রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও আদর্শের ভিত্তিতে সমাজের সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করে।
৩) নৈতিক প্রাধান্যঃ মূল্যবোধ আইন নয়। মূল্যবোধের প্রতি সমাজে বসবাসকারী মানুষের শ্রদ্ধাবোধ আছে বলে মানুষ এটা মেনে চলে।
৪) বৈচিত্র্যময়তা ও আপেক্ষিকতাঃ মূল্যবোধ বৈচিত্র্যময় ও আপেক্ষিক। আজ যা মূল্যবোধ হিসাবে বিবেচিত, কাল তা নিও হতে পারে।
৫) পরিবর্তনশীলতাঃ মূল্যবোধের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর পরিবর্তনশীলতা। সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল আর এ পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে।
মূল্যবোধের ভিত্তি বা উপাদানঃ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যে উপাদানগুলো মূল্যবোধের ভিত্তি বা উপাদান বলে স্বীকার করা হয় তাহলো-
১) নীতি ও ঔচিত্যবোধ,
২) সামাজিক ন্যায়বিচার,
৩) শৃঙ্খলাবোধ,
৪) সহনশীলতা,
৫) সহমর্মিতা,
৬) শ্রমের মর্যাদা,
৭) আইনের শাসন,
৮) নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ,
৯) সরকার ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূখিতা,
১০) সরকার ও রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা।
মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগঃ মূল্যবোধের বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন-
১) সামাজিক মূল্যবোধঃ সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা গুণাবলির সমষ্টি।
২) রাজনৈতিক মূল্যবোধঃ যে চিন্তাভাবনা লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের রাজনৈতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে তার সমষ্টি হলো রাজনৈতিক মূল্যবোধ। রাজনৈতিক সততা, সৌজন্যবোধ, সহনশীলতা, জবাবদিহিতা ইত্যাদি রাজনৈতিক মূল্যবোধের উদাহরণ।
৩) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধঃ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেসব চিন্তাভাবনা, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার ও দৈনন্দিন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
৪) ধর্মীয় মূল্যবোধঃ যে সব ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-আচরণ ধর্মীয় কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই ধর্মীয় মূল্যবোধ। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, ধর্মকর্ম ও ধর্ম প্রচারে বাধা না দেয়া ইত্যাদি ধর্মীয় মূল্যবোধের উদাহরণ।
৫) সাংস্কৃতিক মূল্যবোধঃ যে চিন্তাভাবনা লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সাংস্কৃতিক আচার-ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে তার সমষ্টি হলো সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।
৬) নৈতিক মূল্যবোধঃ নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেই সব মনোভাব এবং আচরণ যা মানুষ সব সময় ভালো ও অপরিহার্য বিবেচনা করে মানসিক তৃপ্তিবোধ করে থাকে।
৭) অর্থনৈতিক মূল্যবোধঃ অর্থনৈতিক জীবনে মানুষকে কিছু কাজ-কর্ম করতে হয়, কিছু বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি ও আদর্শ মেনে চলতে হয়, এগুলোর সমষ্টিই অর্থনৈতিক মূল্যবোধ।
একটা সমাজে/দেশে শান্তিতে বসবাসের জন্য, সুশাসন পাবার জন্য মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
(মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
No comments:
Post a Comment