সামাজিক বিচ্যুতি/বিচ্যুত ব্যবহার কি? সামাজিক বিচ্যুতি/বিচ্যুত ব্যবহারের ধরণ ও কারণ আলোচনা কর।
সামাজিক বিচ্যুতি/বিচ্যুত ব্যবহারঃ সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতি বা বিধি-ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে বিধড-বর্হিরভূত বা রীতি-বিরুদ্ধ আচার-ব্যবহারই হলো সামাজিক বিচ্যুতি। এ ধরনের আচার-ব্যবহারকে বলা হয় বিচ্যুত ব্যবহার এবং এ ধরনের আচরণকারী ব্যক্তিকে বলা হয় বিচ্যুত ব্যক্তি।
বিচ্যুতির সংঙ্গায় P.B. Horton & C.L. Hunt তাদের Sociology বইয়ে বলেছেন, "The term social deviance is given to any failure to conform to the customary norms of the society."
বিভিন্ন ধরনের বিচ্যুত ব্যবহারঃ বিভিন্ন রকমের বিচ্যুত ব্যবহার সমাজে হয়ে থাকতে পারে। যার মধে অন্যতম হলো-
১) চরম প্রকৃতির বিচ্যুত ব্যবহারঃ যে সমস্ত সামাজিক বিচ্যুতি আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় সেগুলো হলো চরম প্রকৃতির বিচ্যুত ব্যবহার।
২) অ-দন্ডনীয় বিচ্যুতিঃ সমাজ যে সমস্ত আচরণ অনুসরণ করা ভালো মনে করে কিন্ত তা মান্য না করলে শাস্তি পেতে হয় না তাই অ-দন্ডনীয় বিচ্যুতি। যেমন- রাস্তা পারাপারের ব্যাপারে বিভিন্ন আচরণ-বিধি।
৩) দন্ডনীয় গৌণ বিচ্যুতিঃ গৌণ মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত বিচ্যুতি দন্ডনীয়ও হতে পারে। তবে এটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় না। যেমন- পাবলিক প্লেসে ধুমপান।
৪) চলতি ধারার বিরোধীঃ সমাজে প্রচলিত ধারার পরিবর্তে নতুন কোন কিছু প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিচ্যুত আচরণ তাই এর আওতাভুক্ত। এর মূল উদ্দেশ্য সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করা।
সামাজিক বিচ্যুতির বিভিন্ন কারণঃ সামাজিক বিচ্যুতির পিছনে বহু ও বিভিন্ন কারণ বর্তমান। তার মধ্যে অন্যতম হলো-
১) অপরাধ প্রবণ সামাজিক পরিবেশঃ ব্যক্তি-মানুষের সামাজিক বিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা অনেকটা প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশের কারণে হয়ে থাকে। অনেক শিশু সমাজবিরোধী মানুষের সাথে বড় হয়, যার কারণে তাদের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি হয়।
২) প্রতিকূল পরিবেশঃ শিশুর মানুষ হওয়ার সময় স্নেহ-ভালবাসা, সহানুভূতি প্রভৃতির প্রয়োজন। কিন্তু দারিদ্র্যতা বা অন্য কারণে শিশু তা না পেলে স্বভাবতই সামাজিক বিধি-বিধান অমান্য করার প্রবণতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৩) ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক কারণঃ অনেক ক্ষেত্রে সামাজিকীকরণের ত্রুটি বিচ্যুতি বিচ্যুত ব্যবহারের পথ প্রস্তুত করে থাকে। অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সচদেব বলেন, "The social scientists are of the opinion that some persons are deviant because the socialization process has failed in some way to integrate the cultural norms into the individual's personality."
৪) মানসিক অসামর্থ্যঃ বিচ্যুত ব্যবহারের অন্যতম কারণ হিসাবে প্রচলিত সামাজিক রীতি-নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে অক্ষমতা বা অসাফল্যের কথা বলা হয়ে থাকে। এ অক্ষমতা মানসিক বা দৈহিক ত্রুটি থেকে সৃষ্টি হতে পারে।
৫) জটিল সমাজ ব্যবস্থাঃ অনেকের মতে বিচ্যুত ব্যবহারের ঘটনা বৃদ্ধির পিছনে অত্যন্ত জটিল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থাও দায়ী। এ প্রসঙ্গে Emile Durkheim বলেন, "When there is a sudden change, the normatic structure of the regulation norms of society is slackened, hence, man does not know what is wrong or what is right, his impulses are excessive, to satisfy them, he seeks anomic."
৬) সামাজিক স্তরবিন্যাসে ব্যক্তির অবস্থানঃ সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের অবস্থান ও মর্যাদা বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে এবং তদনুসারে জীবনধারাগত সুযোগ-সুবিধার প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে। যার কারণেও সামাজিক বিচ্যুতি হয়ে থাকে।
৭) কুসংস্কার বা উপকথাগত বিশ্বাসঃ অনেক সময় কুসংস্কার বা উপকথাগত বিশ্বাসের ভিত্তিতেও বিচ্যুত ব্যবহারের সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ দেবীর কৃপা ও সৌভাগ্য লাভের আশায় শিশুর বলির ঘটনা ঘটে।
৮) ব্যক্তিগত বিষয়ঃ কোন নির্যাতনের ঘটনা বা অমানবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যক্তি-মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। যা বিচ্যুত আচরণ সংঘটিত হবার ক্ষেত্রে দায়ী হয়ে থাকে।
এছাড়াও নানা রকম কারনে সমাজে বিচ্যুত ব্যবহার সংঘটিত হতে পারে। তাই ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে এরকম বিচ্যুত ব্যবহারের রোধ করা সম্ভব হতে পারে।
(মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
No comments:
Post a Comment