বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী ও রাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ নামক দেশটি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান কোন অংশেই কম নয়। নারী ও পুরুষের গভীর আত্মত্যাগই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করেছে। নারীরাও এ স্বাধীন দেশের নাগরিক, অথচ আমাদের সমাজে নারীরা এখেেনা পুরুষ কর্তৃক অবদমিত ও অবহেলিত। তাই নারীর প্রতি এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করে একটি সুষম সমাজ গড়ে তুলে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি আলাদা বিষয় হিসেবে নারীও রাজনীতি অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় গোঁড়ামি বাংলাদেশের সমাজে যে রক্ষণশীলতার জন্ম দিয়েছে নারী তা দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ফলে পুরুষ আধিপত্য বেড়েই চলছে। এর মূল কারণ নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ। নারী ও রাজনীতি অধ্যয়নের ফলে সমাজের এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সম্ভব। এ জন্যই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা খুবই জরুরি।
২. নারী সচেতনতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ আয়থন ও জনসংখ্যার তুলনায় ছোট এবং দরিদ্র দেশ। দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার পরস্পর সহাবস্থান করে। ফলে নারীর উন্নয়ণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নারীরা তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয়। তাই নারী অধ্যয়নের মাধ্যমে নারীদের অনগ্রসরতার কারণগুলো চিহ্নিত করে নারী উন্নয়ণ ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এ কারণেই নারী অধ্যয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. নারী ক্ষমতায়ন : বাংলাাদেশের নারী সমাজ পুরুষের তুলনায় এখনো অনগ্রসর। কেবল পার্লামেন্টের সংরক্ষিত নারী আসনই নারী ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত হতে পারে না। পুরোপুরি নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিবার; সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর ভূমিকা আরো বাড়াতে হবে। নারী ক্ষমতায়নের এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী অধ্যয়ন খুবই জরুরি।
৪. নির্যাতন প্রতিরোধ : নারীনির্যাতন বাংলাদেশের নারী সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই নারীনির্যাতন হচ্ছে। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ধরনের নারীনির্যাতন লক্ষ্য করা যায়। তবে অধিকাংশ নারীনির্যাতন হয়ে থাকে যৌতুক সংক্রান্ত কারণে। এছাড়া এসিড নিক্ষেপ, রাস্তাঘাটে নারীরা ইভটিজিং এর শিকার হয়ে থাকে, ধর্ষিত হয়ে থাকে। নারী নির্যাতনের কারণসমূহ চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় জানার জন্য নারী রাজনীতি অধ্যয়ন আবশ্যক। আর এজন্য চবাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী অধ্যয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. জেন্ডার বৈষম্য দূর করা : নারীদের অনগ্রসরতার আর একটি অন্যতম কারণ হলো জেন্ডার বৈষম্য। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে যে, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে নাগরিকদের মাঝে কোন প্রকার বৈষম্য করা যাবে না, কিন্তু নারী সম্পর্কে সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন- নারী দুর্বল, হীন, পুরুষের অধস্তন, মেধাহীন ইত্যাদি নারী-পুরুষের বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। নারী অধ্যয়নের মাধ্যমে একাডেমিকভাবে জেন্ডার বৈষম্যের কারণ, ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ জানা যায়। বাংলাদেশে নারী ও রাজনীতি অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরি।
৬. ইতিবাচক সামাজিকীকরণ : আজকে নারীর যে অধস্তনত লক্ষ্য করছি তা হাজার বছরের সামাজিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। দীর্ঘদিন যাবৎ অধস্তন থাকার ফলে আমরা লক্ষ্য করছি যে নারী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শুধু পুরুষই নয় বরং অনেক নারীও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এর মূল কারণ নেতিবাচক সমাজিকীকরণ। নারী ও রাজনীতি অধ্যয়নের ফলে এই নেতিবাচক সামাজিকীরকণের প্রভাব দূর করে ইতিবাচক সামাজিকীকরণ করা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারীর ইতিবাচক সামাজিকীকরণের লক্ষ্যেই নারী ও রাজনীতি অধ্যয়ন জরুরি।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা : সামাজিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক নিরাপত্তার সাথে অন্যান্য নিরাপত্তা জড়িত। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতৈ নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ধর্ষণ, রাহাজানি, শ্লীলতাহানী< অবাধে রাস্তাঘাটে চলাচল ইত্যাদি বন্ধ না হলে নারী গৃহের বাইরে যেতে পারের না। তাই নারী অধ্যয়নের মাধ্যমে এ বিষয় বিস্তারিত জানা যাবে না নারীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনী তৈরিতে সহায়তা করবে।
৮. মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা : সুস্থ মা দিতে পারে সুস্থ সন্তানের নিশ্চয়তা আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী বাচ্চা প্রসবকালীন সময় বা মাতৃত্বজনিত জটিলতায় মারা যান। আবার কোন কোন মা মাতৃজনিত মাারাত্মক রোগ বহন করে চলছেন সারাজীবন। এর ফলে নবজাতক শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়< এর প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবারের উপর। তাই এ অবস্থা থেকে নারীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী ও রাজনীতি অধ্যয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৯. নারী শিক্ষা নিশ্চিত করা : নারী উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো নারী শিক্ষা। নারীকে যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করা না গেলে নারীদের মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত করা যাবে না। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার পথে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন- পারিবারিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় গোড়ামি, মৌলবাদ, দারিদ্র্য ইত্যাদি। নারী অধ্যয়নের মাধ্যমে নরী শিক্ষার পথে এসব প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে নারী শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
১০. নারী উন্নয়ন ও দাতা সংস্থার ভূমিকা : নারী ক্ষমতায়ন দাতাগোষ্ঠী ও বিভিন্ন এনজিও’র অন্যতম লক্ষ্য। অধিকাংশ দাতাগোষ্ঠী নারীকে টার্গেট গ্র“প হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে দাতাগোষ্ঠী ও এনজিও কর্তৃক গৃহীথ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্পে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। নারী অধ্যায়নের মাধ্যমে এসব দাবির সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশটির উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে নারীকে সম্পৃক্ত করতে পারলে সত্যিকার অর্থেই এখানে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে। নারীকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ণ গতিশীল করতে নারী ও রাজনীতি অধ্যয়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
No comments:
Post a Comment