Sunday, April 11, 2021

১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য

সংবিধান প্রণয়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে যে সকল নিয়ম নীতির দরকার হয় তার লিখিত রুপই হলো সংবিধান। এই সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ 'বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ' জারি হয়। যার সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০৩ জন। এদের মধ্যে ৪০০ জন আওয়ামী লীগ দলীয়, ১ জন ছিলেন ন্যাপ এবং বাকি ২ জন ছিলেন স্বতন্ত্র। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে এবং ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। কমিটি ৪৭ টি বৈঠক করে ১০ জুন ১৯৭২ সালে প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করেন। ১১ অক্টোবর ১৯৭২ কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়া সংবিধানের চূড়ান্ত রুপ গৃহীত হয়। ১৯ অক্টোবর সংবিধানের উপর প্রথম পাঠ এবং ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয়। যা চলে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। ৪ নভেম্বর সংবিধানের উপর ৩য় ও সর্বশেষ পাঠ শুরু হয় এবং মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে তা শেষ হলে ঐ দিনই বাংলাদেশ সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। এই সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর, প্রথম বিজয় দিবসের দিন থেকে কার্যকর হয়।

বাংলাদেশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহঃ

১) লিখিত সংবিধানঃ বাংলাদেশ সংবিধান লিখিত। ১৫৩ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট ৮২ পৃষ্ঠার এ সংবিধান ১১ টি ভাগে বিভক্ত ১ টি প্রস্তাবনাসহ ৪ টি তফসিল ছিল।
২) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানঃ বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। সাধারণত সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী প্রস্তাব পাস করানো যায়।
৩) রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিঃ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি বাংলাদেশ সংবিধানের মূলনীতি।
৪) মৌলিক অধিকারঃ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যা আদালত কর্তৃক বলবৎ যোগ্য।
৫) এককেন্দ্রিক সরকারঃ সংবিধানের বাংলাদেশকে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারই সকল ক্ষমতার অধিকারী।
৬) প্রজানন্ত্রঃ বাংলাদেশ একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রপ্রধান। তার নামেই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হবে।
৭) সংবিধানের প্রাধান্যঃ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে আইনের ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং ৭ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংবিধান বাতিল, স্থগিতককরণ ইত্যাদি অপরাধ।
৮) সংসদীয় গণতন্ত্রঃ বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভার হাতে দেশ পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। জাতীয় সংসদ সকল ক্ষমতার উৎস এবং মন্ত্রীসভা সংসদের নিকট দায়ী।
৯) ন্যায়পালঃ সংবিধানে ন্যায়পালের কথা বলা হয়েছে। ন্যায়পাল সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির সমান ক্ষমতার অধিকারি হবেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের যেকোন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শুনবেন এবং যেকোন কর্তৃপক্ষকে তার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারবেন।
১০) মালিকানার নীতিঃ বাংলাদেশ সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানার কথা বলা হয়েছে- রাষ্ট্রীয়, সমবয় ও ব্যক্তিগত মালিকানা।
১১) প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালঃ সাধারণ বিচার বিভাগ ছাড়াও সংবিধানে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের কথা বলা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম এর এখতিয়ারভুক্ত।
১২) সর্বজনীন ভোটাধিকারঃ সংবিধানে জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়স্ক যেকোন নাগরিকের ভোটাধিকারের কথা বলা হয়েছে।
১৩) জনগণের সার্বভৌমত্বঃ সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণই সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস। জনগণ প্রত্যক্ষ বা প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনা করবে।
১৪) এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভাঃ বাংলাদেশ সংবিধানে 'জাতীয় সংসদ' নামে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়। যার সদস্য সংখ্যা হবে ৩০০ জন প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত এবং ১৫ জন সংরক্ষিত মহিলা, যা বর্তমানে ৫০ জন।
১৫) বিচার বিভাগঃ বিচার সংক্রান্ত দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকবে। বিচার বিভাগের শীর্ষে থাকবে সুপ্রিম কোর্ট। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হবে।
 
বাংলাদেশ সংবিধানের আরো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, দলীয় শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় সংগীত, প্রতীক ও পতাকা, রাজধানী, নাগরিকত্ব ইত্যাদি।


৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা

No comments:

Post a Comment