পুঁজিবাদ
যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার অধিকার রাখে তাই পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বন্টন, চাহিদা, যোগান, মূল্য নির্ধারণ প্রভৃতিতে ব্যাক্তি উদ্যোগকে সমর্থন করে। বিভিন্ন চিন্তাবিদ পুঁজিবাদের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি হলো-
সমাজবিজ্ঞানী স্কেফার ও ল্যাম বলেন, "পুঁজিবাদ হলো এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের উপায় ব্যক্তির হাতে ন্যাস্ত থাকে, রাষ্ট্রের হাতে নয়। ব্যক্তি তার ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে।"
অধ্যাপক ডি. এম. রাইট এর মতে, পুঁজিবাদে ব্যক্তির কাজ বিশেষ করে নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বেসরকারি উদ্যোগে গৃহীত হয় এবং তা অবাধ প্রতিযোগীতা ও মুনাফা অর্জনের বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়।"
ইবেন স্টাইনের মতে, "পুঁজিবাদ শুধু কোন এক বিশেষ ধরনের অর্থব্যবস্থাই নয়, এটি সমাজব্যবস্থাও বটে।"
পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক বিকাশ
সমাজব্যবস্থায় বিকাশের কোন একটি স্তরে এসে পুঁজিবাদের আবির্ভাব হয়েছে। আর সমাজব্যবস্থার বিকাশ একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। যার মূলকথা হলো, যাবতীয় বস্তু ও ঘটনার মধ্যে দুই বিপরীত সত্তা বিদ্যমান। এই দুই সত্তার দ্বন্দ্বের ফলে বস্তু বা ঘটনার বিকাশ ঘটে। মার্ক্সের দ্বন্দ্ব তত্ত্ব মতে, বস্তুর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব যখন পরিমাণে বাড়ে, তখন বস্তুর গুনগত পরিবর্তন হয় এবং পূর্বতন সত্তা নিরাকরণ বা বিলীন হয়ে নতুন সত্তার উদ্ভব ঘটে। যেমন- পানির গুণগত পরিবর্তন হয়ে বরফে পরিণত হয়। মার্ক্সের মতে, সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের মাঝেও এই তত্ত্ব কার্যকর। যেমন- দাস সমাজে দাস ও দাস মালিকের দ্বন্দ্ব, সামন্তবাদী সমাজে সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসে দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিকের দ্বন্দ্বের ফলে একেকটি সমাজ ভেঙ্গে আরেকটি সমাজের সৃষ্টি হয়েছে।
সমাজবিকাশের এই ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পাঁচটি পর্যায় পাওয়া যায়। অধ্যাপক চার্লস ও বিয়ার্ড এর মতে, এই পাঁচটি ধাপ বা পর্যায় হলো- ১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ, ২) দাস সমাজ, ৩) সামন্ত সমাজ, ৪) পুঁজিবাদী সমাজ এবং ৫) সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এখনে পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশ পর্যন্ত আলোচনা দেয়া হলো।
১) আদিম সাম্যবাদী সমাজঃ আদিমকালে জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ছিল বেশি তাই সে সময়ে ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে সম্পদের পরিমাণ কমতে থাকে এবং মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা জন্ম নেয়া। আস্তে আস্তে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে থাকে এবং একশ্রেণি প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করে সমাজ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়।
২) দাস সমাজঃ আদিম সমাজের উত্তরকালে ক্রমশ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের প্রোয়জন ব্যপ্ত হয় এবং সম্পদকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর পরবর্তীতে মানুষ নিজের স্বার্থেই নিজেদের অধীন করে। শুরু হয় দাস সমাজের। সম্পদের এই সীমাবদ্ধতার কারণে সম্পত্তি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে শ্রেণি-বিভক্তি বা শ্রেণি-বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই শ্রেণি বিরোধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর রাষ্ট্র সম্পদশালীদের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং সম্পদহীনদের শোষণ দমন করে। এই শোষণের চূড়ান্ত পরিণতিতে দাস সমাজ ভেঙ্গে সামন্ত সমাজের সৃষ্টি হয়।
৩) সামন্ত সমাজঃ এ সমাজের শ্রেণিবিন্যাস আরো সূক্ষ ও কঠিন হয়ে উঠে। রাষ্ট্র ক্রমশই ধনীদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে হতে সৃষ্টি হয় এক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সামন্তবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভূমির মালিকানা রুপ নেয় উত্তারাধিকারের আঙ্গিকে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাও সেটাকে অনুসরণ করে হয়ে উঠে বংশানুক্রমিক। সামন্তবাদী সমাজে উৎপাদন মালিকানার উপর কৃষক বা ভূমিদাসদের কোন অধিকার ছিল না। সব অধিকার ছিল মালিকদের। ভূমি মালিকদের শোষণ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যখন ভূমির শোষণ থেকে পুঁজি একীভূত হতে হতে ভূমি মালিক থেকে পুঁজিপতি শ্রেণিতে রুপান্তর ঘটে।
৪) পুঁজিবাদী সমাজঃ সামন্তবাদে যেমন ব্যক্তির সম্পদ ছিল, তেমনি পুঁজিবাদেও ব্যক্তিক সম্পদ বিরাজ করে। তবে সাথে যুক্ত হয়েছে মুনাফা। আর পুঁজিবাদে যে শ্রেণি বিন্যাস হয়েছে তা হলো মালিক ও শ্রমিক এই রুপে। পুঁজিবাদী সমাজে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন হয়ে রাজতন্ত্র গণতন্ত্রে রুপ নেয়। কিন্তু পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে মালিক শ্রেণি অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করে। পুঁজিহীনরা ঐ গণতন্ত্রে ব্যবহৃত হয় মাত্র।
পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
পুঁজিবাদ অর্থব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা উভয়ই। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে। তাই পুঁজিবাদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিন্মে তুলে ধবা হলো-
১) ব্যক্তি মালিকানার উপস্থিতিঃ পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদনের উপকরণসমুহ ব্যক্তিমালিকানার উপর নির্ভরশীল। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছায় উৎপাদন পরিচালিত হয় এবং ব্যক্তির ইচ্ছায় দাম নির্ধারিত হয়।
২) বিরোধী শ্রেণির উপস্থিতিঃ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুইটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। একটি হলো পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণি, অন্যটি সর্বহারা শ্রেণি। পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণিকে শোষক এবং সর্বহারা শ্রেণিকে শোষিক শ্রেণি হিসাবে চিহৃত করা হয়।
৩) বিদেশি বাজারের উপর নির্ভরশীলঃ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোন সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল এবং উৎপাদিত দ্রব্যের জন্য বাজারের প্রয়োজনীয়তায় পুঁজিপতিদের বিদেশি বাজারের উপর নির্ভরশীল হতে হয়।
৪) অবাধ প্রতিযোগীতার উপস্থিতিঃ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগীতা উপস্থিত। ব্যক্তি তার খেয়াল-খুশি মতো ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে নিজের অর্থনীতি পড়ে তুলতে পারে।
৫) ক্রেতা-বিক্রেতার সার্বভৌমত্বঃ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রেতা বিক্রেতা উৎপাদিত পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত স্বাধীনতা ভোগ করে।
আলোচনার শেষে বলা যায়, পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো- ক. উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিমালিকানা এবং খ. উদ্বৃত্ত মূল্যের শোষণ।
(মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
No comments:
Post a Comment