Thursday, April 1, 2021

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অর্থ, প্রকৃতি, পরিধি ও বৈশিষ্ট্য

 প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাঃ

ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রচিন্তাকে দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়। যথা- পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা এবং প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা। ইউরোপীয় দেশসমূহের চিন্তাবিদদের বিপরীতে প্রাচ্যের তথা মিশর, পারস্য, চীন ও ভারতের চিন্তাবিদদের যে রাজনৈতিক চিন্তাধারা তাই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা নামে পরিচিত। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের পদচারণাই মুখ্য।

অন্যভাবে বলা যায়, প্রাচ্যের যে সকল মনীষী ইসলামের বিধিবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাদের চিন্তাধারা ব্যক্ত করতে গিয়ে ইসলাম ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর গুরুত্বারোপ করেন তাই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় আরব, আফ্রিকা, পারস্য, চীন ও ভারতের চিন্তাবিদদের চিন্তাধারাও অন্তর্ভুক্ত।

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যঃ

১। ধর্মের প্রাধান্যঃ রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যযুগে যেমন খ্রিস্টধর্মের প্রভাব বিদ্যমান ছিল তেমনি প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মের প্রাধান্য লক্ষণীয়। যেমন- মিশর, চীন, ভারতের রাষ্ট্রচিন্তা ধর্মের ভিত্তিতেই বিকশিত হয়েছে। আল-ফারাবী, আল-গাজ্জালী, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাকে ইসলামি ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করেই আলোচনা করেছেন।

২। নৈতিকতার প্রাধান্যঃ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো নৈতিক বিধিবিধানের প্রাধান্য। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আলোচনায়, কনফুসিয়াসের জীবন ব্যবস্থায়, মাওবাদের বৈশিষ্ট্যও নৈতিকতাপূর্ণ। আর ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার উৎস যেহেতু ধর্ম, সুতরাং সেখানে নৈতিকতাই মূখ্য।
৩। ইসলামি আইনঃ ইসলামি আইনের মূল উৎস কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও কিয়াস। যা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায়ও বিশেষ অবদান রেখেছে।
৪। খিলাফতঃ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে খিলাফত তথা ইসলামি সরকার ও প্রশাসন ব্যবস্থা।
৫। মৌলিক ধারণায় ইসলামের প্রাধান্যঃ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক ধারণা যেমন- রাষ্ট্র, সরকার, সামজিক ন্যায় বিচার, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, সার্বভৌমত্ব প্রভৃতিতে ইসলামের প্রাধান্য বিদ্যমান।
৬। ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সাথে গ্রিকদর্শনের সমন্বয়সাধনঃ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সাথে গ্রিক সাহিত্য ও দর্শনের সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা। আল-ফারাবী, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে রুশদ্, ইবনে সিনা প্রমুখ মুসলিম চিন্তাবিদ এই প্রচেষ্টায় ভূমিকা রেখেছেন।
৭। রক্ষণশীলতাঃ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় রক্ষণশীলতার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কনফুসিয়াসের দর্শন এমনকি গান্ধীর দর্শনেও রক্ষণশীলতার আভাস পাওয়া যায়। তবে মাওবাদ, এম এন রায়ের দর্শনে বৈপ্লবিক চিন্তার আভাস পাওয়া যায়।
 

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি ও পরিধিঃ

১। ইসলাম সম্পর্কে আলোচনাঃ ইসলাম কি, এর উৎসমূল, বিকাশধারা, বৈশিষ্ট্য, ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধারণা, ইসলাম কিভাবে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে ইত্যাদি বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।
২।ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থাঃ ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলনীতি, ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিক গণতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও সমাজতাত্ত্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা, ইসলামি আইনসভা, রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব-কর্তব্য, নির্বাচন পদ্ধতি, নাগরিকদের অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য, মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও কর্তব্য প্রভৃতি বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আলোচনার ক্ষেত্র।
৩।ইসলামি অর্থব্যবস্থাঃ ইসলামি অর্থব্যবস্থার পরিচয়, এর বৈশিষ্ট্য, ইসলামি রাষ্ট্রে আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, যাকাত, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, সুদ-মুনাফা এবং পাশ্চাত্যের প্রচলিত অর্থব্যবস্থার সাথে ইসলামি অর্থব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা।
৪। ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তারর মৌল ধারণাঃ
৫। নৈতিক বিধানাবলি নিয়ে আলোচনাঃ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় নৈতিক বিধানের উপর গুরুত্বারোপ করে। কেননা উন্নত সমাজের জন্য উন্নত মানব মনের দরকার। UNESCO তার সংবিধানে বলেছে, এ পৃথিবী থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করতে হলে মানব মনকে উন্নত করতে হবে।
৬। ইসলামি আইন সম্পর্কে আলোকপাতঃ
৭। যুদ্ধ, শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিঃ সারা বিশ্ব থেকে অন্যায়-অসংগত যুদ্ধ থেকে মুক্ত রাখার জন্য ইসলামের দিকনির্দেশনা, বিশ্বকে বিশ্ব মানবের জন্য সুখী, সমৃদ্ধশালী, শান্তিময় আবাসভূমি হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ইসলামের সুস্পষ্ট নীতি ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। এসকল বিষয় নিয়ে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় আলোচনা রয়েছে।
৮। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাঃ ইসলামের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহের ভূমিকা, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ইসলাম ইত্যাদি বিষয় নিয়েও প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোকপাত করে থাকে।
 
আন্ত-পরিচিতি ও আত্নশুদ্ধি থেকে শুরু করে পারলৌকিক মুক্তি তথা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় অন্তর্ভুক্ত।
 
 
   (মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)

No comments:

Post a Comment