Wednesday, April 3, 2024

সংগঠনের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য


সব ধরনের সংগঠনেই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দু'টি রূপই পরিলক্ষিত হয়। আনুষ্ঠানিক সংগঠন বলতে বুঝায় সেরূপ সংগঠনকে, যেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের দ্বারা সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পিত ও অনুমোদিত। এ ধরনের সংগঠন সংগঠনচার্টে চিহ্নিত করে প্রদর্শিত হতে পারে এবং অফিস পুস্তিকায় বর্ণিত হতে পারে। অপরপক্ষে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন বলতে বুঝায় সংগঠনে নিযুক্ত ব্যক্তিগণের বাস্তব আচরণের রীতিকে। কোন সংগঠন তা যতই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিকল্পিত বা নিপুণভাবে রচিত হোক না কেন, সেখানে আচরণ রীতিগত অনেক শূন্যতা থেকে যাবার আশংকা থাকে। এসব শূন্যতা দূরীভূত করার জন্য অনানুষ্ঠানিক আচরণবিধির উদ্ভব ঘটে । ফলে সংগঠনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কাদিও সংশোধিত হয়। সংগঠনের সুষ্ঠু ও সফল কার্যকারিতার জন্য আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সমভাবে প্রয়োজন রয়েছে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কেরও।

সংগঠনের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য (Distinguish Between Formal and Informal Theory of Organization): নিচে সংগঠনের আনুষ্ঠানিক বা সনাতন এবং অনানুষ্ঠানিক বা নয়া সনাতন মতবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা হলোঃ

১। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠন হলো ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ কার্যের শ্রেণীবিভাগ এবং শ্রেণীবিভাগের সাথে পদসোপান নীতি অনুযায়ী একটি চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। অপরদিকে অনানুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠন হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে কর্মরত ও ব্যক্তিগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।

২। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠনের রূপ, কাঠামো এবং কার্য পদ্ধতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এটি একটি যান্ত্রিক মতবাদ। অপরদিকে অনানুষ্ঠানিক মতবাদ সংগঠনের কাঠামোর জন্য মানবিক দিকের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে।

৩। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠনের বিভিন্ন অংশের যুক্তিসঙ্গত ও কার্যকর সম্পর্কের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অনানুষ্ঠানিক মতবাদ সংগঠনের কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়৷

৪। সংগঠনের অনানুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী এটি গড়ে উঠে অতি সূক্ষ্মভাবে। সামাজিক অর্থনৈতিক ভাবগত ও শিক্ষাগত পার্থক্য ইত্যাদি এর বিষয়বস্তু। অপরদিকে আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠনে অবস্থানরত কর্মচারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

৫। আনুষ্ঠানিক মতবাদ কর্তৃত্ব হস্তান্তর এবং কার্যগত প্রক্রিয়াকে পূর্ণাঙ্গ বলে গ্রহণ করে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক মতবাদটি পূর্ণাঙ্গ নয় বরং এটি মানবিক সমস্যার সৃষ্টি করে।

৬। আনুষ্ঠানিক মতবাদ যুক্তিভিত্তিক। অপরদিকে, অনানুষ্ঠানিক মতবাদ আবেগনির্ভর ও ব্যক্তিনির্ভর।

৭। নয়া সনাতন মতবাদ অনুযায়ী অনেক সময় আনুষ্ঠানিক গোষ্ঠী অনানুষ্ঠানিক গোষ্ঠীর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আনুষ্ঠানিক মতবাদে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক গোষ্ঠী বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

৮। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠন মানুষের মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক মতবাদটি মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দেয়। মানুষ এখানে জীবন্ত সত্তা৷

৯। আনুষ্ঠানিক মতবাদটি সরকারব্যবস্থার আইন দ্বারা এবং ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অনানুষ্ঠানিক মতবাদ আইন হতে নয় বরং প্রচলিত প্রথা হতে উদ্ভূত।

১০। আনুষ্ঠানিক তত্ত্বটি লিখিত এবং এটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক মতবাদটি অলিখিত। এটি রেখাচিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায় না।

১১। পদসোপানভিত্তিক কর্মচারীদের বিন্যাস আনুষ্ঠানিক তত্ত্বে প্রস্ফুটিত। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক মতবাদটি কর্মচারীদের মধ্যে সমতার নীতিতে বিশ্বাসী।

১২। আনুষ্ঠানিক তত্ত্বটি কাঠামো কার্যগত ধরণা থেকে উদ্ভূত। অনানুষ্ঠানিক মতবাদ সমাজবিজ্ঞানী ও আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত।

ফিফনার ও প্রেসথাস (Pfiffner and Presthus) আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের মধ্যকার সম্বন্ধ সম্পর্কে বলেন-

"১। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংগঠন অভিন্নও হতে পারে বা নাও হতে পারে।

২। অনানুষ্ঠানিক সংগঠন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যসমূহ প্রতিহত করে এবং তাকে ব্যর্থ করে দিতে চায়। কিন্তু আনুষ্ঠানিক সংগঠন এরূপ ধ্বংসাত্মক হতে পারে আবার নাও হতে পারে।

৩। অনানুষ্ঠানিক দিকগুলো সংগঠনের অপরিহার্য বিষয়। সুতরাং ব্যবস্থাপক কর্তৃপক্ষের উচিত ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যসমূহ কার্যকর করার ক্ষেত্রে এগুলোকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করা।

৪। যে ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের প্রধান দিকগুলোর সমন্বয় ঘটে সেগুলো সুস্থ ও পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।"
 

সবশেষে বলা যায়, সনাতন মতবাদ অনুযায়ী সংগঠন হচ্ছে আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা কাঠমো যা কতকগুলো সুস্পষ্ট নীতি বা সূত্রের মাধ্যমে গড়ে উঠে। এ তত্ত্বটিতে মানবিক দিক সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। অপরদিকে অনানুষ্ঠানিক তত্ত্বটি মানব সম্পর্কভিত্তিক একটি প্রথা, যা সনাতন তত্ত্বের দোষ-ত্রুটি নির্ণয়ের সহায়ক। যার ফলশ্রুতিতে উভয় মতবাদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। তবে যদিও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান তথাপি দু'টি মতবাদ একে অপরের পরিপূরক। কারণ একটি থেকে আর একটির জন্ম।

No comments:

Post a Comment