Wednesday, July 19, 2023

ফরাসি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

 ফরাসি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো?

উত্তরঃ

১৯৪৬ সালে ফ্রান্সে চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধান চালু হবার সময় থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত— এই ১২ বছরের মধ্যে বার বার (২০ বার) মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে ফ্রান্সের সংবিধান এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে। এই সংকটজনক অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জেনারেল দ্য গলকে (General De Gaulle) একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতঃপর দ্য গলের নির্দেশে এবং মাইকেল ডেব্রে (Michael Debre)-র নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র কমিটি গঠন করা হয় এই উদ্দেশ্যে। মাত্র ২ মাসের মধ্যে এই কমিটি নতুন সংবিধানের একটি খসড়া প্রস্তুত করে। ১৯৫৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর সেটিকে গণভোটে পেশ করা হয় এবং বিপুল ভোটে জনগণ কর্তৃক গৃহীত হলে সংবিধানটি ঐ বছরের ৪ঠা অক্টোবর থেকে চালু করা হয়। এই নতুন সংবিধানটি ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান বলে পরিচিত। নিম্নে এই সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হল-

১) লিখিত সংবিধানঃ ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা সহ ৯২টি ধারা রয়েছে। ধারাগুলি আবার ১৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত।

২) প্রস্তাবনাঃ সংবিধানের শুরুতে একটি প্রস্তাবনা যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবনায় মানুষের অধিকার ও জাতীয় সার্বভৌমিকতার ওপর অবিচল আস্থা জ্ঞাপন করা হয়েছে এবং স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে একটি সুসংহত শক্তিশালী সমাজ গঠনের কথা বলা হয়েছে।

৩) সাধারণতন্ত্রের প্রকৃতিঃ ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে সাধারণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করা হয়েছে। সংবিধানের ২নং ধারায় ফ্রান্সকে একটি “অবিভাজ্য, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক সাধারণতন্ত্র” (an indivisible, secular, democratic and social Republic) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সাধারণতন্ত্রের মর্মবাণী হবে— “স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব”।

৪) গণ-সার্বভৌমিকতার স্বীকৃতিঃ সংবিধানের ৩নং ধারায় গণ-সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমিকতা জনগণের হাতে নাস্ত’ (‘National Soivereignty belongs to the people ‘ )। এই গণ সর্বভৌমিকতার আদর্শকে কার্যকর করার জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকারের নীতিকে স্বীকার করা হয়েছে।

৫) রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে সংমিশ্রণঃ বর্তমান ফরাসী সংবিধানে রাষ্ট্রপতি-শাসিত এবং সংসদ শাসিত শাসনব্যবস্থার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ন্যায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতিও শাসন বিভাগের প্রকৃত প্রধান। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মত অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন। এগুলি সবই রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। অপর দিকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ন্যায় ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে আইনসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকেন।

 

৬) অসামঞ্জস্যের নীতিঃ ফ্রান্সে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে কিছু অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। এখানে রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসন বিভাগীয় প্রধান হলেও সম্পাদিত কার্যাবলীর জন্য তিনি পার্লামেন্টের নিকট দায়িত্বশীল নন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রিগণ পার্লামেন্টের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের পার্লামেন্টের নিকট দায়িত্বশীল করা হয়েছে। ডরোথি পিকলস্ (Dorothy Pickles) এটিকে ফরাসী সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য ‘উদ্ভাবন’ (innovation) বলে অভিহিত করেছেন।

৭) রাষ্ট্রপতির জরুরী ক্ষমতাঃ ভারতের রাষ্ট্রপতির ন্যায় ফরাসী রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১৬নং ধারায় বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো, জাতির স্বাধীনতা, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা, অথবা তার আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পূরণ যখন গুরুতর বিপদের সম্মুখীন হয় এবং সংবিধানের দ্বারা নির্দিষ্ট সরকারী কর্তৃত্বের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তাহলে, রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।

৮) এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাঃ ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুরোমাত্রায় এককেন্দ্রিক। সমগ্র ফ্রান্সকে প্রথমে ভূখণ্ডগত দিক থেকে কয়েকটি ডিপার্টমেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট-গুলিকে আবার ক্যান্টন, অ্যারনডাইজমেন্ট (Arrondisement) এবং কমিউনে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলিকে পরিচালনা করার জন্য প্রতিটি স্তরে স্থানীয় সংস্থাসমূহ থাকলেও ব্রিটেনের মতো এখানে ক্ষমতা বিকেন্দ্রিত হয় নি। পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের দ্বারা তাদের ক্ষমতা নির্ধারিত হয়। বস্তুত স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন-মূলক সংস্থাগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘এজেন্ট’ হিসাবে কাজ করে থাকে।

৯) গণভোটের ব্যবস্থাঃ ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল গণভোট ব্যবস্থার প্রবর্তন। সংবিধানের ১১ এবং ৮৯ এই দুটি ধারাতে গণভোটের আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ১১নং ধারায় বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভার প্রস্তাব অনুসারে অথবা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ প্রস্তাব অনুসারে সরকারী কর্তৃপক্ষের সংগঠন, কোন চুক্তি বা সন্ধির অনুমোদন সংক্রান্ত বিল রাষ্ট্রপতি গণভোটে দিতে পারেন। সংবিধানের ৮৯নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংবিধান সংশোধন সম্পর্কেও গণভোট গ্রহণ করতে পারেন।

১০) দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাঃ ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় আইনসভা পার্লামেন্ট দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চকক্ষের নাম সিনেট এবং নিম্ন কক্ষের নাম জাতীয় সভা। উচ্চকক্ষের সদস্যরা পরোক্ষভাবে এবং নিম্নকক্ষের সদস্যরা সার্বিক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন।

১১) সাংবিধানিক পরিষদঃ সাংবিধানিক পরিষদ হল ফরাসী শাসনব্যবস্থার একটি অভিনব প্রতিষ্ঠান। এই পরিষদের সদস্যসংখ্যা ৯ জন। রাষ্ট্রপতি, সিনেটের সভাপতি এবং জাতীয় সভার সভাপতি— এই ৩ জন প্রত্যেকে ৩ জন করে সদস্য এই পরিষদে মনোনীত করেন। এছাড়াও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিগণ পদাধিকারবলে এই পরিষদের সদস্য। এর কার্যকালের মেয়াদ ৯ বছর। দেশের সাধারণ আইন ও সাংগঠনিক (organic) আইনের বৈধতা বিচার করা, জরুরী অবস্থা ঘোষণার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি হল সাংবিধানিক পরিষদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

১২) অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদঃ পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। সরকার ও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক সংগঠন কর্তৃক মনোনীত ২০৫ জন সদস্য নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের কাজ হল বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী বিল সম্পর্কে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে পর্যালোচনা করা এবং সরকারকে পরামর্শ দেওয়া।

১৩) কমিউনিটিঃ পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে বহির্দেশীয় ভূখণ্ড (Overseas territories) ও উপনিবেশগুলি সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করা হয়েছে। চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের “ইউনিয়ন” শব্দটির পরিবর্তে ‘কমিউনিটি’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে। সংবিধানের ১নং ধারা অনুসারে এই কমিউনিটি গঠিত হবে ফরাসী সাধারণতন্ত্র এবং বহির্দেশীয় সেই সব ভূখণ্ডের জাতিগুলিকে নিয়ে যারা স্বাধীন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই সংবিধানকে গ্রহণ করবে। এই ফরাসী কমিউনিটি প্রতিষ্ঠিত হবে সদস্য-জাতিগুলির সাম্য ও সংহতির ওপর ভিত্তি করে। এদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকার করা হয়েছে এবং এরা ইচ্ছা করলে যে-কোন সময় কমিউনিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে।

১৪) বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে। উচ্চতর বিচারালয়ের বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া—এসবের জন্য ফ্রান্সে বিচারবিভাগীয় উচ্চতর পরিষদ (Higher Council of the Judiciary) নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এই সংস্থার সভাপতি হিসাবে কাজ করেন।

১৫) দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানঃ ফ্রান্সের সংবিধানকে দুষ্পরিবর্তনীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি অথবা পার্লামেন্টের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পর প্রস্তাবটিকে প্রথমে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদিত হতে হয়। তারপর গণভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্মতি লাভ করলে সংশোধন প্রস্তাবটি কার্যকর হয়।

 

ফরাসী শাসনতন্ত্রের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই শাসনতন্ত্রে কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শকে গ্রহণ করার পরিবর্তে বিভিন্ন মতাদর্শ, ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে সংবিধানের অনেক অংশই অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। ফরাসী সংবিধান বিশ্লেষক ডরোথি পিকলস্ (D. Pickles) এই সংবিধানকে ‘একটি অপরিচ্ছন্ন’ (untidy), ‘অস্পষ্ট’ (obscure), ‘অনিশ্চিত (ambiguous), ‘বিভ্রান্তিকর’ (confused), এবং ‘পরস্পর-বিরোধী’ (contradictory) বলে মন্তব্য করেন। অনেকে আবার এই সংবিধানকে প্রজাতন্ত্রের মোড়কে ঢাকা একটি রাজতান্ত্রিক সংবিধান বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মতে, ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক ঐতিহ্য প্রবল প্রতাপান্বিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার কাছে বলি প্রদত্ত হয়েছে।

 

 ফরাসি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা

মোঃ হেলাল উদ্দিন

 

No comments:

Post a Comment