Monday, February 15, 2021

সফল হওয়ার ছয় রহস্য -- আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার

হলিউড অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের জন্ম ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই। শোয়ার্জনেগার পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন ‘দ্য টার্মিনেটর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এছাড়া ‘কোনান দ্য বার্বারিয়ান’, ‘প্রিডেটর’ তাঁর বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র। একাধারে তিনি একজন অভিনেতা, বডিবিল্ডার, মডেল ও রাজনীতিবিদ। তিনি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের গভর্নর। ২০০৯ সালের ১৫মে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া’র সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য প্রদান করেন।

আজকের দিনটি খুবই চমৎকার একটা দিন, বিশেষ একটা দিন। আজ এখানে তোমরা সাড়ে চার হাজার স্নাতক মিলিত হয়েছ, যার মধ্যে দুই হাজার ২০০ জন ছেলে আর দুই হাজার ৩০০ জন মেয়ে। তোমাদের কাছে আজকের এ দিনটি আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
তোমরা অনেকেই হয়তো জানো, আমার মেয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বর্ষ সম্পন্ন করল। আমার মেয়ের কেবল পথ চলা শুরু আর তোমাদের শেষ। আমি জানি, তোমরা কিছুটা চাপ অনুভব করছ, কারণ তোমরা তোমাদের জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। অনেকেই বলে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন অনেক সুখের, অনেক আরামপ্রিয় কিন্তু বের হওয়ার পরের জীবন অনেক কঠিন। আমার মনে হয়, এগুলো একদল মূর্খের কথা।
আজকে আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত ধারণা বিনিময় করব। কীভাবে আমি সফল হয়েছি, কীভাবে আমি আজকের শোয়ার্জনেগারে পরিণত হয়েছি। আমি সব সময়ই চাইতাম, আমি এক নম্বর হব। আমি যখন বডি বিল্ডিং (শরীর গঠন) করা শুরু করেছিলাম, তখন আমি একবারও ভাবিনি, আমাকে শুধু চ্যাম্পিয়ন হলেই চলবে, ভেবেছি, আমি হব সর্বকালের সেরা বডিবিল্ডার। ঠিক একইভাবে চলচ্চিত্র জগতেও আমি শুধু তারকা হতে চাইনি, হতে চেয়েছি উদাহরণ। আমার একাগ্রতা, আমার আত্মবিশ্বাস আমাকে সফল করেছে।
আমি আজ সফল হওয়ার ছয়টি সূত্রের কথা বলব। অবশ্য এগুলো আমার নিজস্ব ধারণা।
প্রথম সূত্র হলো, নিজেকে বিশ্বাস করো। আমি এই কথাটি দিয়ে যা বলতে চেয়েছি, তা হলো আজকালকার তরুণেরা তাদের মা-বাবা, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে অনেক উপদেশ পায়। কিন্তু কোন উপদেশটি তার জন্য ভালো, এটা তাকেই বুঝতে হবে। আমি অনেক ভাগ্যবান। আমি যখন ছোট থেকে বড় হয়েছি তখন এত টিভি বা টেলিফোন ছিল না, ছিল না কম্পিউটার বা আইপডও। আমি আমাকে অনেক সময় দিতে পেরেছি। আমি অনুভব করতে পারতাম, আমার মন কী বলে, আর বুদ্ধি কী বলে। আমি আমার স্বপ্নকে বুঝতে পারতাম। আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আমি একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আমার আইডল রেগ পার্ককে দেখলাম, তিনি হারকিউলিস চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তিনি ছিলেন মিস্টার ইউনিভার্স। তাঁকে দেখে উদ্বুদ্ধ হলাম এবং বাসায় ফিরে মা-বাবাকে বললাম, ‘আমি বডি বিল্ডিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই।’ তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারেননি। বরং এর চেয়ে তাঁরা খুশি হতেন যদি বাবার মতো আমিও পুলিশ কর্মকর্তা হতে চাইতাম। কিন্তু আমি চেয়েছি, সবার থেকে ভিন্ন হতে। আমি অনেক বড় স্বপ্ন দেখতাম। আমাকে অনেকেই বলত, তুমি যদি খেলাধুলোতেই চ্যাম্পিয়ন হতে চাও, তবে বাইসাইকেল, রেসিং কিংবা ফুটবল খেলে চ্যাম্পিয়ন হও। কিন্তু আমি বডিবিল্ডার হতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল এটা দিয়ে আমি চলচ্চিত্রে নামব এবং অনেক টাকা উপার্জন করব।
দ্বিতীয় সূত্র হলো, নিয়মনীতি ভেঙে ফেল। সবকিছু সম্পর্কে আমাদের অনেক নিয়মকানুন আছে। আমি বলি, নিয়ম ভেঙে ফেল। আইন ভাঙার দরকার নেই (ব্রেক দ্য রুলস, নট দ্য ল)।
আমি যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গেছি, তখন আমাকে অনেক নিয়মকানুন শেখানো হয়েছিল—এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, আমি সেগুলোর কিছুই শুনিনি। কারণ, সেগুলো তাদের নিয়মনীতি ছিল, আমার ছিল না। আমি আমাকে বুঝিয়েছি, আমি পারব। তখন থেকে আমি আরও কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম। অভিনয়ের ক্লাস করতাম, ইংরেজির ক্লাস করতাম, বক্তৃতার ক্লাস করতাম ইত্যাদি। পরবর্তী সময় আমি সফল হলাম ‘পাম্পিং আইরন’ দিয়ে। তারপর তো সব জানাই আছে। মূল কথা হলো, যেগুলো তুমি করতে পারবে না, তা তোমার শোনার দরকারই নেই।
তৃতীয় সূত্র হলো, পরাজয়কে ভয় করা যাবে না। আমি পরাজয়কে সঙ্গে রেখেই কাজ করেছি। টার্মিনেটর, প্রিডেটর অ্যান্ড টুইনস দিয়ে আমি যখন সফল হয়েছি, তখন অনেক চলচ্চিত্রই সাফল্যের মুখ দেখেনি। কিন্তু আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করিনি। তুমি সব সময় জিততে পারবে না এটা ঠিক, কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেয়ো না যেন।
পরাজয়কে ভয় করে নিজেকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস ঠিক রেখো, আর ভেবো, তুমি যা-ই করছ, এটা তোমার সঠিক পথ, তাহলে সাফল্য আসবেই। সুতরাং পরাজয়কে ভয় পেয়ো না।
চতুর্থত, যারা নিন্দুক, তাদের কথা শুনো না, আমলে নিয়ো না। যেকোনো কাজের বিপক্ষেই শুনবে, অনেকেই বলছে—তুমি এটা করতে পারবে না, এটা এর আগে কেউ করতে পারেনি। কল্পনা করো, বিল গেটস মাইক্রোসফট যখন শুরু করেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন, এটা তিনি করতে পারবেন না। কিন্তু বিল গেটস কী করতে পেরেছেন আর কী করতে পারেননি, তা তোমরা খুব ভালোভাবেই জানো।
আবার বারাক ওবামাকে দেখো। তিনি যদি নিন্দুকের কথা শুনতেন, তবে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে পারতেন না। লোকজন বলত, তিনি হিলারি ক্লিনটনকেই টপকাতে পারবেন না আর প্রেসিডেন্ট হবেন কীভাবে? কিন্তু বারাক ওবামা ইতিহাসকে বদলে দিয়েই প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
নিন্দুকের কথা যদি আমি নিজে শুনতাম, তবে আমি টার্মিনেটর করতে পারতাম না, একজন গভর্নর হয়ে আজকে তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পারতাম না। আমি কখনোই শুনিনি, আমি পারব না। আমি সব সময় আমাকে শুনিয়েছি, ‘হ্যাঁ, আমি পারি।’
পঞ্চমত, সাধ্য অনুযায়ী কাজ করে যাওয়া, পরিশ্রম করা। যেটা তোমার আয়ত্তের বাইরে সেটার পেছনে কঠিন পরিশ্রম করে লাভ নেই। যতটুকু তোমার পক্ষে সম্ভব, তা-ই করবে, তবেই তুমি সফল হবে। আমি তা-ই করেছি।
আমার প্রিয় চরিত্রের একজন, বিখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘তুমি কতবার উঠবস করতে পারো?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার উঠবস গুনি না। আমি তখনই গুনি, যখন কষ্ট অনুভব করতে শুরু করি, যখন পায়ে ব্যথা অনুভব করি। কারণ, তখনই সত্যিকারের গোনা শুরু হয়।’ সুতরাং সফল হতে গেলে পরিশ্রম করতেই হবে। সঠিক পথে পরিশ্রম করতে হবে। কষ্ট না করলে ভালো কিছু অর্জন করা যায় না। যদি তুমি জিততে চাও, তবে কঠিন পরিশ্রম তোমাকে করতেই হবে। এ ছাড়া কোনো পথ নেই।
ষষ্ঠত, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তুমি যে পথে যেভাবেই জীবনযাপন করো না কেন মানুষের জন্য কিছু সময় দিয়ো, সমাজের জন্য কিছু কোরো, দেশের ভালোর জন্য পারলে কাজ করে যেয়ো।
আমার শ্বশুর সার্জেন্ট শ্রিভের, তিনি আমেরিকার বিশাল এক মহৎ মানুষ ছিলেন, যিনি ‘পিস কোর’, ‘জবস কোর’ গরিবদের আইনি সহায়তা শুরু করেছিলেন। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘তুমি আয়নার দিকে তাকিয়ে তোমাকে দেখো, তোমাকেই দেখতে পাও। কিন্তু আয়নার ওপাশে হাজারো মানুষ তোমাকে দেখছে। তোমার একটু সাহায্য-সহযোগিতার জন্য লাখ লাখ মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।’
আজকে তোমরা গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাচ্ছ, একজন গ্র্যাজুয়েট হয়ে কখনোই হারতে শিখ না। তুমি মনে রেখো, তোমার জীবনে তুমিই সব, তুমিই সেনাপতি। তোমাদের জন্য শুভকামনা।

  (মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
 

No comments:

Post a Comment