“মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব এবং যে সমাজে বাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু।” – এরিস্টটল
মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের জন্য নাগরিক জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়েছে কতিপয় নিয়ম-কানুনের সমষ্টি, যা বর্তমান সময়ে এসে আরো বৃহৎ আকার ধারন করেছে। নাগরিকের এই সব নিয়ম-নীতির সাথে সাথে তৈরি হওয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য গড়ে উঠেছে জ্ঞানের এক নতুন শাখা যার নাম পৌরনীতি। পৌরনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। নাগরিকতা সর্ম্পকিত আলোচনা করাই পৌরনীতিকে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞানও বলা হয়ে থাকে।
পৌরনীতি যার ইংরেজি প্রতিশব্দ যা ল্যাটিন থেকে নেয়া। এর অর্থ যথাক্রমে নাগরিক ও নগররাষ্ট্র। সুতরাং পৌরনীতি হলো নগররাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকদের কার্যাবলি সংক্রান্ত আলোচনা। তবে বর্তমানে জাতি রাষ্ট্র হওয়ায় এর আলোচনার পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তাই পৌরনীতিকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়-
“পৌরিনীতি হচ্ছে জ্ঞানের সেই শাখা, যা নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং স্থানীয়, জাতীয় ও মানবতার সাথে জড়িত সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।” - ই. এম. হোয়াইট
“পৌরনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা বলে অভিহিত করা যায়, যেখানে সরকারের সংঠন ও পদ্ধতি এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ আলোচনা করা হয়।” –
মোটকথা, নাগরিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে যে শাখা আলোচনা করে তাই পৌরনীতি।
পৌরনীতির পরিধি ও বিষয়বস্তু
পৌরনীতির পরিধি ও বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে- ১) নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ২) নাগরিক অধিকার, কর্তব্য ও মানবাধিকার, ৩) মানব সভ্যতার আদি সংগঠন, ৪) সামাজিক পরিবর্তন ও সামাজিক মূল্যবোধ, ৫) রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও কার্যাবলি, ৬) আইন ও নৈতিকতা, স্বাধীনতা ও সাম্য, দেশপ্রেম ও জাতীয়তা, জনসেবা ও আমলাতন্ত্র, ৭) ই-গভর্নেন্স ও সুশাসন, 8) নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন ও নির্বাচকমন্ডলী, ৯) জনমত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ১০) সংবিধান, সরকারের শ্রেণিভেদ, সরকারের প্রকৃতি ও অঙ্গ সমূহ এবং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি।
পৌরনীতি পাঠের গুরুত্ব
যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে পৌরনীতি তার প্রায় সকল দিক নিয়েই আলোচনা করে থাকে, এই জন্যই পৌরনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও ক) সুস্থ, সুন্দর সামাজিক জীবন গঠন, খ) সুনাগরিকতার শিক্ষা, উদর নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিক অধিকার, কর্তব্য ও গণতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি, গ) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং এর বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পর্কে জানার জন্য, ঘ) দেশপ্রেম ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং যোগ্য নেতৃত্ব তৈরীর জন্য পৌরনীতির পাঠ দরকার। মোটকথা, সুন্দর ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে তুলতে হলে পৌরনীতির জ্ঞান অর্জন করা একান্ত প্রয়োজনীয়।
পৌরনীতির সাথে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সম্পর্ক
পৌরনীতি সামাজিক বিজ্ঞান হবার কারণে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান- ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, ভূগোল ও নীতিশাস্ত্র প্রভৃতির সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- পরিধি, পদ্ধতি ও বিষয়বস্তুগত পার্থক্য থাকলেও ইতিহাস ও পৌরনীতি পরস্পরের পরিপূরক ও সহায়ক। (অধ্যাপক গেটেল)। এ জন্যই অধ্যাপক সিলি বলেছেন, “ইতিহাস ব্যতীত পৌরনীতি ভিত্তিহীন এবং পৌরনীতি ব্যতীত ইতিহাস মূল্যহীন।” লর্ড এক্টন বলেন, “ইতিহাসের স্রোতধারায় বালুকারাশির মধ্যে স্বর্ণরেণুর মতো রাজনীতি বিজ্ঞান সঞ্চিত হয়ে উঠেছে”
আবার এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।” সুতরাং বলা যায় যে, পৌরনীতির সাথে সমাজ বিজ্ঞানের গভীর, ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান এবং একে অপরের পরিপূরক। গেটেলের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটা ধরে নেয়া হয় যে, মানুষ রাজনৈতিক জীব। কিন্তু মানুষ কিভাবে ও কেন রাজনৈতিক জীব- সমাজ বিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে।”
অন্যদিকে, পৌরনীতি ও অর্থনীতি উভয়ের লক্ষ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন করা। আবার, রাষ্ট্র ও সরকারের সফলতা নির্ভর করে অর্থনৈতিক সফলতার উপর। অপরদিকে, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং পরিকল্পনা সমূহ রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সুতরাং বলা চলে, পৌরনীতি ও অর্থনীতি পরস্পর নির্ভরশীল।
(মোঃ হেলাল উদ্দিন, ৩৩ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা)
No comments:
Post a Comment