Tuesday, June 17, 2025

আল-ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসকের গুণাবলি -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

আল-ফারাবী ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ইসলামী দার্শনিক যিনি রাজনীতি, নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রচিন্তার ওপর ব্যাপকভাবে লিখেছেন। তাঁর রচিত "আল-মাদীনাতুল ফাদিলা" (আদর্শ রাষ্ট্র) গ্রন্থে তিনি আদর্শ রাষ্ট্র ও তার শাসকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এমন একজন শাসক থাকা উচিত যিনি শুধু রাজনৈতিক দক্ষতাসম্পন্ন নন, বরং জ্ঞান, ন্যায়বিচার এবং নৈতিক গুণে সমৃদ্ধ।


আল-ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসকের গুণাবলি:

১. জ্ঞানী ও দার্শনিক:

শাসককে অবশ্যই জ্ঞানী হতে হবে। আল-ফারাবীর মতে, একজন আদর্শ শাসক হতে হলে দার্শনিক হতে হবে, যিনি সত্য, ন্যায় ও বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি রাখেন। তিনি প্লেটোর "ফিলোসফার কিং"-এর ধারণা থেকে প্রভাবিত।


২. নৈতিক গুণসম্পন্ন:

শাসকের মধ্যে উচ্চ নৈতিক গুণ থাকতে হবে, যেমন সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মসংযম, ধৈর্য এবং সদিচ্ছা।


৩. দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান:

তিনি ভবিষ্যতের কল্যাণ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য কাজ করবেন।


৪. সাহসী ও দৃঢ়চেতা:

আদর্শ শাসকের সাহস থাকতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে। তিনি ভয় বা প্রলোভনে পা দেবেন না।


৫. শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী:

শাসকের ব্যক্তিত্ব হতে হবে অনুকরণীয়। তিনি প্রজাদের মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেন।


৬. শ্রবণযোগ্য ও বুদ্ধিমান:

জনগণের কথা শুনতে এবং তাদের সমস্যা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তিবাদী হবেন।


৭. শিক্ষা ও দীক্ষায় পরিপূর্ণ:

শাসককে বৈজ্ঞানিক, ধর্মীয় এবং দার্শনিক জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে, যাতে তিনি জ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন।


৮. মানবকল্যাণে উৎসর্গিত:

তিনি নিজের স্বার্থ নয়, জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে নিবেদিত থাকবেন।


উপসংহার:

আল-ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক কেবলমাত্র রাজনীতিক নয়, তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানব, যিনি নৈতিকতা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও মানবিকতাকে একত্রিত করে সমাজকে একটি ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালনা করেন। তাঁর এই আদর্শ শাসকচিন্তা পরবর্তীকালে ইসলামী ও পাশ্চাত্য রাজনীতিবিদ্যায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।

Monday, November 18, 2024

নৈতিকতার ধারণা এবং আইন ও নৈতিকতার পার্থক্য -- মোঃ হেলাল উদ্দিন


পৌরনীতি ও নাগরিকতা, নগর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র, নাগরিকের জীবন সব কিছু নিয়ে আলোচনা করে। নাগরিকের মর্যাদা, অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ জাতীয়, আইন সাম্য, স্বাধীনতা, নীতি নৈতিকতা আদর্শ ইত্যাদি সকল দিক এর অন্তর্ভূক্ত। পরিধির বিস্তৃতি এ বিষয়টিকে অনন্য করেছে। আধুনিক নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ে আরও নতুন নতুন অনেক বিষয় যোগ হচ্ছে।

নৈতিকতা (Morality): নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Morality’। ইংরেজি Morality শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘Moralitas' থেকে, যার অর্থ সঠিক আচরণ বা চরিত্র'। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল সর্বপ্রথম নৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। সক্রেটিস বলেছেন, “সৎ গুণই জ্ঞান' (Virtue is knowledge)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বোধের উৎস, হচ্ছে 'জ্ঞান' (knowledge) এবং অন্যায়বোধের উৎস হচ্ছে 'অজ্ঞতা' (ignorance)। পরবর্তীতে রোমান দার্শনিকরা প্রথাগত আচরণের অর্থে ‘mas' কথাটি ব্যবহার করেন। ল্যাটিন এই ‘mas’ শব্দ থেকেই Morals ও Morality (নৈতিকতা) শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।

জোনাথান হেইট (Jonathan Haidt) মনে করেন, 'ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ—তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।'

নীতিবিদ ম্যুর বলেছেন, ‘শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।'

Cambridge International Dictionary of English-তে বলা হয়েছে যে, নৈতিকতা হলো 'ভালো-মন্দ আচরণ, স্বচ্ছতা, সততা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি গুণ, যা প্রত্যেক ব্যক্তিই আইন কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।”

নৈতিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Collins English Dictionary-তে বলা হয়েছে যে, 'Morality is concerned with on negating to, human behavior, esp. the distinction between good and bad and right and wrong behavior.'

নৈতিকতা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত ধ্যান-ধারণার সমষ্টি যা মানুষকে সুকুমার বৃত্তি অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করে। নৈতিকতা বা ন্যায়বোধ মানসিক বিষয়। এটি হলো মানবমনের উচ্চ গুণাবলি। নৈতিকতা বা নীতিবোধ একান্তভাবেই মানুষের হৃদয়-মন থেকে উৎসারিত। নৈতিকতা বা নীতিবোধের বিকাশ ঘটে মানুষের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বা অনুভূতি থেকে।

শুধুমাত্র আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানই নাগরিক জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। আর. এম. ম্যাকাইভার এ জন বলেছেন যে ‘Law, does not and can not cover all grounds of morality'।

নৈতিকতা বা ন্যায়নীতিবোধের ধারণা বা এর প্রতি যে দেশের জনগণের শ্রদ্ধাবোধ বেশি, যারা জীবনের চলার পথে নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত হন, তারা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে লিপ্ত হন না। আইন অপেক্ষা বিবেক দ্বারা তারা পরিচালিত হন। নীতিবান মানুষ ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির মানদণ্ডে নিজেরাই চলার চেষ্টা করে।

নৈতিকতার পিছনে সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সমর্থন বা কর্তৃত্ব থাকে না। কেননা নৈতিকতা বিবেক ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। রাষ্ট্র নৈতিকবিধি প্রয়োগ করে না। নৈতিকতা বিরোধী ব্যক্তিকে রাষ্ট্র কোনো প্রকার দৈহিক শাস্তি প্ৰদান করে না। বিবেকের দংশনই নৈতিকতার বড় রক্ষাকবচ।

নৈতিকতা মূলত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাপার। নৈতিকতা মানুষের মানসিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণ সাধনই নৈতিকতার লক্ষ্য। যে রাষ্ট্রের মানুষের নৈতিক মান সুউচ্চ, সেদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ। কেননা সেদেশের নাগরিকগণ নিজেরাই অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকেন, ঘুষ দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন।

আইন ও নৈতিকতা (Law and Morality): অতীতে নীতিবিজ্ঞান ছিল পৌরনীতিরই অংশবিশেষ। নৈতিকতার কষ্টিপাথরে রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও আচার-আচরণকে তখন বিচার করা হতো। প্লেটো এবং এরিস্টটল তাদের আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় নৈতিক আদর্শের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ইতালির প্রখ্যাত রাষ্ট্র দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি সর্বপ্রথম আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন।

আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্যগুলো নিম্নরূপঃ
ক. পরিধি ও বিষয়বস্তুগত পার্থক্যঃ
আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মন বা মানসিক অনুভূতির সাথে আইনের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। আইন মানুষের গোপন চিন্তা বা উদ্দেশ্যকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। অপরদিকে নৈতিকতা মানুষের বাহ্যিক ও মানসিক আচরণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং নৈতিকতার পরিধি আইনের পরিধি অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যাপক।

খ. নির্দিষ্টতা ও স্পষ্টতা সম্পর্কিত পার্থক্যঃ আইন নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট, কিন্তু নৈতিকতা অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট। আইন সর্বজনীন। দেশের সর্বত্র একই রকম আইন কার্যকর হয়। নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আইন কার্যকর ও ব্যাখ্যা করে থাকেন। অপরদিকে নৈতিকতা আইনের মতো সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। দেশ-কাল-পাত্রভেদে নৈতিকতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক সময়ে ভারতবর্ষে বিধবা বিবাহ অনৈতিক মনে করা হতো কিন্তু এখন তা মনে করা হয় না। অস্পৃশ্যতাকে ও বর্ণ প্রথাকে এক সময় অনৈতিক মনে করা হতো না। কিন্তু বর্তমানে অস্পৃশ্যতা, বর্ণপ্রথাকে অনৈতিক বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া নৈতিকতা মূলত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাপার, অপরদিকে আইন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার।

গ. উচিত-অনুচিতের মানদণ্ডগত পার্থক্যঃ
নৈতিকতা কোনো কাজকে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির মানদণ্ডে বিচার করে। আইন সেভাবে বা সে মানদণ্ডে বিচার করে না। আইনের মানদণ্ড ভিন্ন। আলো ছাড়া গাড়ি চালানো কিংবা রাস্তার বামদিক দিয়ে না চলে ডানদিক দিয়ে চলা নৈতিকতা বিরোধী নয়, কিন্তু বেআইনি । অন্যদিকে মিথ্যা কথা বলা, অকারণে কারো মনে কষ্ট দেয়া, গালমন্দ করা বেআইনি নয়, কিন্তু নৈতিকতা বিরোধী। সুতরাং আইনবোধ সব ক্ষেত্রে এবং সব সময় এক হতে পারে না।

ঘ. বলবৎকরণের ক্ষেত্রে পার্থক্যঃ আইনের পিছনে রয়েছে সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সমর্থন; কিন্তু নৈতিকতা সামাজিক বিবেক ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইন প্রয়োগ করে থাকে রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী শক্তি। আইন ভঙ্গকারীকে আইনের আলোকে শাস্তি পেতে হয়। অপরদিকে, নৈতিকতার পিছনে রাষ্ট্রের মতো কোনো বলপ্রয়োগকারী শক্তি নেই। রাষ্ট্র নৈতিক বিধি প্রয়োগ করে না । নৈতিকতা বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকলে কাউকে কোনো নির্দিষ্ট দৈহিক শাস্তিও ভোগ করতে হয় না। নৈতিকতা বিরোধী ব্যক্তিকে বড় জোর বিবেকের দংশন সহ্য করতে হয় এবং জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।

আইন ও নৈতিকতার মধ্যে মিল বা সাদৃশ্য নিম্নরূপঃ
১. লক্ষ্যের অভিন্নতাঃ আইন ও নৈতিকতার লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। উভয়ের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের আচরণ। আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং নৈতিকতা মানুষের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণ সাধন করাই উভয়ের লক্ষ্য।

২. ঘনিষ্ঠতাঃ আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আইন হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বোধের প্রতিফলন। যে দেশের নৈতিক মূল্যবোধের মান খুব নিচু, সে দেশের আইন কখনো উচ্চমান সম্পন্ন হতে পারে না। মানুষের নৈতিকতাবোধ রাষ্ট্রীয় আইনকে প্রভাবিত ও সাহায্য করে। সমাজ জীবনে উৎকর্ষতা সাধনে আইন ও নৈতিকতা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।

৩. একে অপরকে প্রভাবিত করেঃ ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা যেমন অনেক সময় আইনে পরিণত হয়, তেমনি আইনও অনেক সময় কুনীতিকে দূর করে সুনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। সতীদাহ বা সহমরণ প্রথাকে এক সময় ভারতে নীতি বা ধর্মের অঙ্গ মনে করা হতো। ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে। বর্তমানে প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই অস্পৃশ্যতা ও বর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আইন রচিত হয়েছে। অস্পৃশ্যতা ও বর্ণ প্রথা এখন তাই শুধু নৈতিকতা বিরোধীই নয়, বরং প্রায় সব রাষ্ট্রে এখন তা বেআইনি। সুতরাং আইনের কার্যকারিতা যেমন মানুষের নৈতিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি সময় ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্যহীন নৈতিক বিশ্বাসও আইনের দ্বারা পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়। রাষ্ট্র সাধারণত নৈতিক আদর্শকে অনুসরণ করে।

৪. সমাজ ও রাষ্ট্র নির্ভরতাঃ আইনের মতোই নৈতিকতাও সমাজ এবং রাষ্ট্র-নির্ভর। সমাজব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে নৈতিক ধারণা ও আদর্শেরও পরিবর্তন ঘটে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সম্পত্তি অর্জন এবং প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবাধ ও নির্মম প্রতিযোগিতা চলে। স্বার্থপরতা ও লোভই সেখানে প্রতিষ্ঠালাভের ভিত্তি। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি হলো সামাজিক স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া।
 

উপরোক্ত আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় যে, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয়ের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ও মধুর। উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। যখন কোনো আইন-নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তখনই তা জনগণ কর্তৃক সমাদৃত হয়। নৈতিকতা বিরোধী আইন কোনো দিনই জনসমর্থন লাভ করেনি এবং টিকেও থাকেনি। 

নৈতিকতার ধারণা এবং আইন ও নৈতিকতার পার্থক্য -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

Sunday, September 29, 2024

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় এবং নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয়ঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেঃ

১. সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশঃ সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলো ভোগের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করতে এবং তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে না। অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে নাগরিকের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে।

২. মত প্রকাশের স্বাধীনতাঃ প্রত্যেক নাগরিককে তার চিন্তা, মত ও বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। কেননা এসব অধিকার ব্যতীত কোন ব্যক্তি সভ্য ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে না। এসব অধিকারের অভাবে ব্যক্তিসত্তারও পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না।

৩. শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধানঃ সহিংসতার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেন সমস্যার সমাধান বা দাবি-দাওয়া মেটানো যায় তার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। আলোচনার পরিবেশ তৈরি ও সবসময় তা বজায় রাখতে হবে।

৪. দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠাঃ দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে শাসন বিভাগ সবসময় তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্য আইনসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার হলে সেক্ষেত্রে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।

৫. জবাবদিহিমূলক জনপ্রশাসনঃ দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সবসময় দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ করবে।

৬. দক্ষ ও কার্যকর সরকারঃ দক্ষ ও কার্যকর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার দক্ষ না হলে এবং কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে কোনোদিনই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

৭. জনসম্মতিঃ সরকারের কাজের বৈধতা অর্থাৎ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি জনগণের সম্মতি থাকতে হবে।

৮. সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণঃ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে তৎপর হতে হবে। উচ্চাভিঙ্গাধী ও ভুল সিদ্ধান্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত করে।

৯. স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠাঃ সরকারের কাজ এবং গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্ত হতে হবে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। জনগণ যেন সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝতে পারেন। এরূপ হলে রাষ্ট্রীয় কাজে জন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে।

১০. একাধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিঃ একাধিক রাজনৈতিক দল থাকতে হবে এবং তারা যেন তাদের কার্যকলাপ স্বাধীনভাবে চালাতে পারে, মত প্রকাশ করতে পারে, সংঘটিত হতে পারে, তার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।

১১. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনঃ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে মুক্ত, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের হাতে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।

১২. ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়োগঃ ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ও আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাতে হবে এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে এবং তা প্রচার করতে হবে।

১৩. দক্ষ জনশক্তিঃ আকস্মিক উদ্ভূত বিষয় মোকাবিলায় পারঙ্গম হতে হবে। এজন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

১৪. বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে সাবধানতাঃ বিতর্কিত বিষয়ে সাবধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কোনো অবস্থায় যেন কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

১৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাঃ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের যথার্থ প্রয়োগ যেন ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

১৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান এবং সামাজিক মর্যাদা প্রদান, বেতন-ভাতা প্রদান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।

১৭. আইনসভাকে গতিশীল ও কার্যকর করাঃ সংসদকে গতিশীল ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। সংসদ সদস্যগণকে সংসদে বসেই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়নে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।

১৮. সহিংসতা পরিহারঃ রাজপথে সহিংস আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও ছেড়ে সংসদে বসে আলোচনার টেবিলে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

১৯. স্পষ্ট, সহজবোধ্য ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়নঃ এমন আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করতে হবে যেন তা হয় স্পষ্ট ও সহজবোধ্য। আইন হবে সময়োপযোগী।

২০. ব্যাপক জনঅংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিঃ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কাজ ও নীতি প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং নাগরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকতে হবে।

২১. শক্তিশালী স্থানীয় সরকারঃ শক্তিশালী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার গড়ে তুলতে হবে। এগুলোর ওপর কোনো ধরনের বাহ্যিক খবরদারি অর্থাৎ প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা জাতীয় সংসদ সদস্যদের খবরদারি না থাকাই শ্রেয়৷

২২. সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নঃ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। শুধু সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করলেই চলবে না, তা বাস্তবায়নও করতে হবে।

২৩. দারিদ্র্য দূরীকরণঃ সরকারকে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য বাস্তবসম্মত ও সুসমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

২৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণঃ সুশাসন সম্পর্কে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সম্পর্কে, সরকারের স্থায়িত্বশীলতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে, জনগণকে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে, সাম্প্রদায়িক শক্তির অপতৎপরতা সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য সরকারের প্রচারযন্ত্রকে সবল করে তুলতে হবে।

২৫. ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাঃ সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

২৬. কার্যকর মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠাঃ স্বাধীন, ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন ও কার্যকর মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করে আইনের শাসন ও মানবাধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

২৭. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধিঃ কোনো জঙ্গী, মৌলবাদী, অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন বিনষ্ট না হয়-সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু সরকারকেই সচেষ্ট হতে হবে তা নয়। এজন্য নাগরিকেরও অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কেননা কর্তব্যবিমুখ জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিম্নরূপঃ

১. সামাজিক দায়িত্ব পালন (To Perform Social Duties): সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি গড়ে ওঠে নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। এগুলো হলো- সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলা এবং তা বজায় রাখা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন বা নির্মাণ এবং তা পরিচালনা করা, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং এতে অংশগ্রহণ করা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সমাজে বসবাসকারী মানুষকে কুসংস্কার মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা ইত্যাদি হলো নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব।

২. রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন (Unconditional allegiance to the State): রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করা সকল নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রের আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে।

৩. আইন মান্য করা (Obedience to Law): রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আইন তৈরি হয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নততর সমাজজীবন প্রতিষ্ঠার জন্য। আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। আইন শুধু নিজে মানলেই হবে না, অন্যেরাও যেন আইন মেনে চলে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

৪. সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন (Selection of honest and qualified leadership): নির্বাচনে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সততা ও বিজ্ঞতার সাথে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত করা উচিত। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

৫. নিয়মিত কর প্রদান (Regular Payment of Taxes): রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করে। কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজ সুসম্পন্ন হয়। নাগরিকগণ যদি স্বেচ্ছায় যথাসময়ে কর প্রদান না করে তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে এবং সুশাসন বাধাগ্রস্ত হবে।

৬. রাষ্ট্রের সেবা করা (Public Service): রাষ্ট্রের সেবা করা, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদত্ত অবৈতনিক দায়িত্ব পালন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের সেবা করা, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কোনো রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তা করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করা নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব।

৭. সন্তানদের শিক্ষাদান (To Educate the Children): শিক্ষা ব্যতীত নাগরিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে না। শিক্ষা নাগরিককে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে সচেতন করে। উপযুক্ত শিক্ষা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। পিতামাতার উচিত সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কুসংস্কার মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা, যেন তারা বড় হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে।

৮. রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ (Participation in Development Activities): জনগণের জন্যই রাষ্ট্র। কাজেই রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। যে কোনো দুর্যোগে, আপদে- বিপদে জনগণকে তা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

৯. জাতীয় সম্পদ রক্ষা (Protect Public Property): রাষ্ট্রের সকল সম্পদই জনগণের সম্পদ (Public Property)। কাজেই জন সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে জনগণকেই। হরতালের সময় আবেগবশত কিংবা দুষ্কৃতিকারী ও অসৎ নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কেউ যেন রাষ্ট্রীয় তথা জনসম্পদ ভাংচুর বা বিনষ্ট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধ্বংসাত্মক কাজে নিজে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যদেরকেও বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

১০. আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করা (To help law and order and Discipline): দেশে যদি আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হয় বা ভেঙে পড়ে তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এর ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্যই সকল নাগরিককে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চোর-ডাকাত-দুষ্কৃতিকারী, উগ্র, হিংস্র, জঙ্গীদের সন্ধান বা অবস্থান জানাতে হবে।

১১. সচেতন ও সজাগ হতে হবে (Be Conscious and Alert): সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকগণকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। নাগরিকগণ সজাগ ও সচেতন হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা তাদের অধিকার হরণ করতে পারবে না, স্বেচ্ছাচারী হতে পারবে না, সরকার দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ করতে বাধ্য হবে।

১২. সংবিধান মেনে চলা (To abide by Constitution): সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল নাগরিককে সংবিধান মেনে চলতে হবে; সবকিছুর ওপর সংবিধানকে স্থান দিতে হবে।

১৩. সুশাসনের আগ্রহ (Eagerness to Good governance): সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের আগ্রহ থাকতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একজন নাগরিককে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে, দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে, দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।

১৪. উদার ও প্রগতিশীল দলের প্রতি সমর্থন (Selection of Liberal & Progressive Political Party): সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিককে উদার ও প্রগতিশীল দলের প্রতি সমর্থন জানাতে হবে, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয়দানকারী দল ও ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঘৃণা জানাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেন হরতাল, ধর্মঘট, জ্বালাও-পোড়াও নীতি পরিহার করে এজন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

 

  সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় এবং নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য -- মোঃ হেলাল উদ্দিন