Friday, October 3, 2025

জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

জন অস্টিনকে (১৯২১–১৯৯৯) বলা হয় একত্ববাদী সার্বভৌমত্বের জনক। তাঁর সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। তিনি তার “Legal Positivism” দর্শনের ভিত্তিতে তিনি সার্বভৌমত্বকে ব্যাখ্যা করেছেন। অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা যা আইন প্রণয়ন এবং তার কার্যকরতা নিশ্চিত করে। সার্বভৌমত্বের ধারণা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। এটি এমন এক ক্ষমতা যা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। 

অস্টিনের তত্ত্বে, সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা  নির্দিষ্ট সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশই আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। তার মতে, সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ এবং অভ্রান্ত।

 

অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য

১।  আইনের উৎস: অস্টিনের মতে, সার্বভৌম হলো সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যার আদেশ অনুসারে আইন তৈরি হয়। এই আইন মেনে চলতে জনগণ বাধ্য থাকে। সার্বভৌমত্বের আদেশই আইন হিসেবে গণ্য হয়।

২।  সর্বোচ্চ ক্ষমতা: সার্বভৌম ক্ষমতা হল নিরঙ্কুশ এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এটি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। 

৩। নির্ধারিত গোষ্ঠী: অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ করা হয়। এই গোষ্ঠী হলো সেই জনগণ যারা সার্বভৌমের আদেশ মেনে চলে এবং এর নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকে। 

৪। আদেশ ও বাধ্যবাধকতা: আইন হলো সার্বভৌম কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ, যা মেনে চলতে জনগণ বাধ্য। এই আদেশ অমান্য করলে শাস্তির বিধান প্রয়োগ করা হয়। 

৫। আদেশের অভ্যাস: অস্টিনের মতে, জনগণ সার্বভৌমের আদেশ মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলে। এটি একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

৬। প্রতিসম আদেশের অভাব: সার্বভৌম নিজে তার আদেশ মেনে চলতে বাধ্য নয় এবং তার আদেশের উপর অন্য কোনো আদেশ চাপানো যায় না।

৭। অবিচ্ছিন্ন ক্ষমতা: অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা অবিচ্ছিন্ন। এটি অন্য কোনো শক্তির দ্বারা লঘু করা যায় না। সার্বভৌমত্বের এই বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রের শাসন ও আইন কার্যকর রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৮। নিরঙ্কুশতা: সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ এবং এর আদেশের উপর কোনো প্রকার সীমাবদ্ধতা বা বাধা আরোপ করা যায় না।

৯। বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতকরণ: অস্টিনের তত্ত্বে জনগণ সার্বভৌমের আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য এবং এর ব্যতিক্রম হলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

১০। সার্বভৌমের প্রতি আনুগত্য: সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের প্রতি জনগণের আনুগত্য বাধ্যতামূলক। এই আনুগত্য রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক।

১১। আইন ও নৈতিকতার পৃথকীকরণ: অস্টিনের মতে, আইন এবং নৈতিকতা পৃথক। আইন সার্বভৌম কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ, নৈতিকতার সাথে এর কোনো সংযোগ নেই।

১২। ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা: সার্বভৌম ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত এবং এটি বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বিভাজিত নয়। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হিসেবে কাজ করে।

১৩। সার্বভৌমত্বের চিরন্তনতা: অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব চিরন্তন এবং এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। এটি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না।


সমালোচনা:

অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হলেও এটি বিভিন্ন ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার জন্য সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এর কতিপয় সমালোচনাগুলো  উল্লেখ করা হলো:

১। বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্য: আধুনিক রাষ্ট্রের বাস্তবতায় ক্ষমতা এককেন্দ্রিক নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি একত্রে কাজ করে। অস্টিনের একক সার্বভৌম শক্তির ধারণা এই বহুমাত্রিক বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না।

২। গণতন্ত্র বিরোধী: সার্বভৌমত্বের ধারণা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৩। আইনের বৈধতার উপেক্ষা: অস্টিন জনগণের সম্মতি ও নৈতিক মানদণ্ডকে গুরুত্ব দেননি। তিনি আইনকে কেবল সার্বভৌমের আদেশ হিসেবে দেখেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই জনস্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

৪। প্লুরালিস্টিক সমালোচনা: বহুত্ববাদী দর্শনের প্রবক্তারা মনে করেন আধুনিক সমাজে ক্ষমতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভাজিত। পরিবার, ধর্মীয় গোষ্ঠী, এবং পেশাজীবী সংগঠনের মতো প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অস্টিনের তত্ত্ব এই বহুত্ববাদী বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছে।

৫। স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি: একক সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা স্বেচ্ছাচারিতার পথ তৈরি করতে পারে। এটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে যেটি ব্যক্তি অধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ।

৬। আন্তর্জাতিক সীমাবদ্ধতা: আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ, এবং বহির্বিশ্বের চাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অস্টিনের তত্ত্ব এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় আনেনি।

৭। অপর্যাপ্ত মাপকাঠি: অস্টিনের তত্ত্বে সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের আনুগত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। এতে আইন এবং ক্ষমতার সীমানা অস্পষ্ট রয়ে যায়।

৮। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিচার বিভাগ, আইনসভা, এবং নির্বাহী বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করে। অস্টিনের তত্ত্বে এই বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিবেচনা নেই।

৯। নৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা: অস্টিন আইনের নৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করেননি। তার মতে, আইন কেবল সার্বভৌমের আদেশ, যা প্রায়ই সামাজিক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে যেতে পারে।

১০। সার্বভৌমত্বের সীমাবদ্ধতা: আধুনিক রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণ সীমাহীন নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক চুক্তি, এবং অর্থনৈতিক চাপ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

এছাড়াও অস্টিন ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের জটিলতাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন । তাঁর তত্ত্ব প্রাচীন রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য প্রাসঙ্গিক হলেও আধুনিক রাষ্ট্রে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বৈশ্বিক সংস্থার প্রভাবের কারণে তার তত্ত্ব কার্যকর নয়।


পরিশেষে বলা যায়, অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব একটি নিরঙ্কুশ এবং শক্তিশালী ধারণা হিসেবে রাষ্ট্রের আইন ও শাসন ব্যবস্থার কাঠামো নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাব রয়েছে, তবুও অস্টিনের তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অস্টিনের তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়। 

Wednesday, July 9, 2025

বাংলাদেশ উন্নত, অনুন্নত না উন্নয়নশীল দেশ ?

বাংলাদেশ একটি উন্নত, অনুন্নত না উন্নয়নশীল দেশ তা র কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রেক্ষিতে বিচার করা প্রয়োজন। তাই নিয়ে র প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো।

১। কৃষিখাতের প্রাধান্যঃ বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির প্রায় ৪৭.৫% কৃষি শ্রমিক । ২০১২-১৩ অর্থবছরের জিডিপি'তে কৃষিখাতের অবদান ছিল ১৬.৭৮ শতাংশ, ২০১৩- ১৪ অর্থবছরে এ খাতের অবদান দাড়িয়েছে ১৬.৩৩ শতাংশ। সুতরাং কৃষির উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল ।

২। অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থাঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের নিরক্ষরতা, প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষাবাদ, কৃষি উপকরণের অভাব প্রভৃতি কারণে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির হার খুব কম । 

৩। অনুন্নত শিল্পঃ মূলধনের অপর্যাপ্ততা, দক্ষ উদ্যোক্তা ও দক্ষ শ্রমিকের অভাব ইত্যাদি কারণেবাংলাদেশের শিল্পখাত খুবই অনুন্নত ফলে জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান খুবই কম। তবে ধীর গতিতে এ অবদান বাড়ছে । 

৪। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো তেমন উন্নত নয় । অনুন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত জ্বালানী ও বিদ্যুৎ শক্তি, শিক্ষার হার নিম্ন, স্বাস্থ্য সুবিধা অপ্রতুল, এ সমস্ত কারণেঅর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন- স্বাধীনতা উত্তরকালে যেখানে মাত্র ৪ হাজার কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক ছিল সেখানে ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত সওজ অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ২১,২৭২ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ৩১,৩৫৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার নীট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৭.২১% বেশি ।

৫। কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবঃ কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে যা উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বিরাট প্রতিবন্ধক ।

৬। স্বল্প মাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবনযাত্রার মানঃ বাংলাদেশের একটি গুরুতপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাথাপিছু আয় কম এবং জীবনযাত্রার মান নিম্ন। উন্নত দেশের তুলনায় তা খুবই কম। তবে মাথাপিছু আয় ধীর গতিতে হলেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সেই সাথে জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে। 

৭। মূলধনের স্বল্পতাঃ বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কম বলে সঞ্চয় ক্ষমতা কম । ফলে মূলধন গঠনের হারও বেশ কম। তবে তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তালিকায় বিভিন্ন বছরে দেশের GDP এর মধ্যে সঞ্চয়ের অনুপাত দেখানো হলো ।

৮। শিক্ষার হার কমঃ বাংলাদেশে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম। এখনও দেশে অনেক লোক অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও নিরক্ষর রয়েছে। ২০০২ সালের হিসাব অনুযায়ী বয়স্ক শিক্ষার হার (১৫+) হলো শতকরা ৬২.৬৬ ভাগ মাত্র । উন্নত দেশে এ হার প্রায় ১০০ শত ভাগ ।

৯। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এ দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ বিদ্যমান। ২০০৫ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৩.৭০ কোটি যা ২০১১-১২ (সাময়িক প্রাক্কলন) এ হয় ১৫.১৬ কোটি। ২০০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৪% এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৬৪ জন ।

১০। বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতাঃ বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কার্যাবলী মূলত বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। উন্নয়ন বাজেটের ৫০% বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর। তবে বর্তমানে এ নির্ভরশীলতা হ্রাস পাচ্ছে ।

১১। খাদ্য সমস্যাঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষি ব্যবস্থার অনুন্নতি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এদেশে প্রতি বছর খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বিদেশ থেকে প্রতি বছর খাদ্য আমদানি করতে হয় । তবে খাদ্য শস্য উৎপাদন ব্যবস্থায় বিগত কয়েক বছর ধরে একটি ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে । নিমের তালিকায় বিভিন্ন বৎসরের খাদ্যশস্য উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ দেখানো হলো ।  

১২। বেকার সমস্যাঃ বাংলাদেশে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট । এদেশে মোট শ্রমশক্তির ৩০% বেকার এবং ২৫% প্রচ্ছন্ন বেকার। সরকারি হিসাব অনুযায়ী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১ কোটির উর্ধ্বে ।

১৩। মুদ্রাস্ফীতিঃ বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি একটি বড় সমস্যা। বিশ্বব্যাপী জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি, খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস, বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশেও বর্তমানে মূল্যস্তর বাড়ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ১০- ১১% ।

১৪। প্রতিকূল বৈদেশিক বাণিজ্যঃ এ দেশে কাঁচামাল রপ্তানী, শিল্পজাত পণ্য আমদানি, উদ্যোক্তার অভাব, নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন, আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ে না উঠা প্রভৃতি কারণে বাণিজ্য ঘাটতি লেগেই রয়েছে ।

উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কে কোনভাবেই উন্নত অর্থনীতি বলা যায় না। অপরদিকে অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। এজন্য সাধারণভাবে বাংলাদেশকে অনুন্নত দেশ বলে মনে হয়। তবে অনুন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশের প্রধান পার্থক্য “অর্থনৈতিক স্থবিরতা” তা বাংলাদেশে অবর্তমান। বরং উন্নয়নশীল দেশের প্রধান লক্ষন অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতা বাংলাদেশে লক্ষ্যণীয়। এ গতিশীলতা সৃষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের বৃদ্ধি। যেমন ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪% যা পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.২১%। ফলে এ দেশে একটি উন্নয়নের ধাপ সৃষ্টি হয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার পরিমাণ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ৪.২১% এ নেমে এসেছে। বয়স্ক শিক্ষার হার ৫০% থেকে বেড়ে ৬৮% এ উন্নীত হয়েছে। কৃষিখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। মোট জিডিপিতে শিল্পসহ অন্যান্য অ-কৃষিখাতের অবদানও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় দেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে এবং অর্থনৈতিতে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশকে নিঃসন্দেহে একটি উন্নয়নশীল দেশ বলাই যুক্তি সংগত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা -- মোঃ হেলাল উদ্দিন

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালিদের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এ আন্দোলন পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহকে একধাপ এগিয়ে দেয় । অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগণের মধ্যে এ আন্দোলন এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় । এসব চেতনাই ক্রমে-ক্রমে পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় । জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন । ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই অর্জিত হয় বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা। 

ভাষা আন্দোলন : 

ঐতিহাসিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমেই দেখা দেয় ভাষা সমস্যা। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই পশ্চিমা স্বার্থান্বেষী মহল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করতে থাকে। বাংলার জাতীয় ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনার বীজ রোপিত হয় যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই নিখিল পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। 

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে আন্দোলন শুরু হয়, তা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’সহ বিভিন্ন সংগঠনের অধীনে ধর্মঘট, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো নাম না জানা শহীদের জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে । এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন হিসেবে অভিহিত ।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব/ফলাফল/গুরুত্ব : 

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সময়ে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলি বাঙালিদের স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। ভাষা আন্দোলন নিছক একটি প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না, এর তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব / ফলাফল / গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১. জাতীয় চেতনার সূচনাকারী : 

নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে সংগঠিত জাতীয় চেতনার সূত্রপাত ঘটায়। এ আন্দোলনের চরম ত্যাগের মহিমা বাঙালি জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাতীয়রূপ প্রদান করে। পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামসমূহে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে যে জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে তার উন্মেষ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ।

২. ধর্মনিরপেক্ষ জাগতিক চিন্তার বিকাশ :

পাকিস্তানের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল করে দেয় ভাষা আন্দোলন। তদস্থলে জাতি গঠনে নিরপেক্ষ ও জাগতিক ধারণার জন্ম দেয়। ধর্ম যেকোনো জাতির ঐক্যবদ্ধতার একমাত্র প্রতীক নয়; বরং ভাষাও যে অপরিহার্য উপাদান তার স্বীকৃতি প্রথম সূচিত হয় এ আন্দোলনে। পৃথিবীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ভাষাকে কেন্দ্র করে এ জাতীয় আন্দোলনে বাঙালি জাতিই সর্বপ্রথম এ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে ।

৩. জাতীয় একাত্মতা ও সংহতির জন্মদাতা : 

পাকিস্তান আন্দোলনের সময় এদেশের বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় যে মুসলিম জাতীয়তাভিত্তিক একাত্মতা ও সংহতির চেতনা সৃষ্টি করেছিল, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সে জায়গায় নবতর ও ভিন্নতর জাতীয় একাত্মতা ও সংহতিবোধ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি অপশাসন ও অপচেষ্টার কারণে বাঙালিরা নিজেদেরকে স্বদেশে পরদেশি ভাবতে বাধ্য হয় এবং নতুন জাতিসত্তার সন্ধানে এগিয়ে আসে।

৪. বিপ্লব ও বিদ্রোহের প্রেরণা : 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে বিপ্লবী হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায় এবং তাদের অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উদ্দীপনা সৃষ্টি করে । অন্যায়কে মেনে না নিয়ে তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিদ্রোহ করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা যে জরুরি সে শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অসামান্য । এর মধ্য দিয়ে জাতি বারবার তার উপর আসা আক্রমণ প্রতিহত করার শিক্ষা লাভ করে।

৫. মধ্যবিত্ত বাঙালিদের উত্থান : 

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পাকিস্তানের পূর্বাংশের রাজনীতিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সবক’টি আন্দোলনেই নেতৃত্বের রশি থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে। ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পুঁজিপতি শ্রেণীর একচেটিয়া প্রভাব বাধাগ্রস্ত হয় ।

৬. রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত : 

প্রথম অবস্থায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য । কিন্তু ভাষার দাবি পূরণের জন্য যেহেতু রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল, সেহেতু তা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে । এ আন্দোলনে সর্বস্তরের বাঙালি জনগণের অংশগ্রহণের কারণ ছিল তিনটি । যথা- (ক) পাঞ্জাবি আমলা ও সেনাচক্রের গণবিরোধী স্বায়ত্তশাসন বা বিরোধী-শাসন, (খ) অর্থনৈতিক শোষণ এবং (গ) বাঙালিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ । ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিছক ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জনগণের দাবি হয়ে গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছিল।

৭. গণতান্ত্রিক চেতনার সৃষ্টি :

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে মুষ্টিমেয় লোকের মুখের ভাষা উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার পাঁয়তারা চালায় । বাঙালিরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে রুখে দাঁড়ায় । ভাষা আন্দোলন এ সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে যে, গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ও স্বীকৃতি । যেকোনো পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হলে তা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয় । গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে বীর বাঙালি বারবার ব্যর্থ করে দেয় সকল কূটচক্র ও ষড়যন্ত্র ।

৮. বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ :

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালিরা সর্বপ্রথম নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা, স্বতন্ত্র অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে । পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে শুধু ধর্মের বন্ধন ছাড়া বাঙালিদের যে আর কোনো সম্পর্ক নেই, সে সম্পর্কে তারা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৯৫২ সালের মহান একুশের রক্তদানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয়, সে চেতনা থেকেই ২১-এর প্রতীক ২১-দফা প্রণয়ন করে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতৃবৃন্দ ১৯৫৪ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার মাটিতে খাজা নাজিমউদ্দীন, নূরুল আমীনের পকেট সংগঠন মুসলিম লীগের কবর রচিত হয় । ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরো বিকশিত হতে থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক নতুন দিগ্‌দর্শন । এ আন্দোলন বাঙালিদের মনে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও ঐক্যের উন্মেষ ঘটায়, তা দেশটির পরবর্তী সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায় । ভাষা আন্দোলনের চেতনা ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায় । ভাষা আন্দোলন তুলে ধরে বাঙালিদের নতুন পরিচিতি; বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলসূত্রই নিহিত রয়েছে ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে।